হিম হিম বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ঠকঠক করে হাড় কাঁপে। খাদের পাশে কমলাবন আবছা হয়ে গেল। ঘন ঝোঁপ, নিবিড় অরণ্য, বুনো লতাপাতার জটিল বাঁধনে জড়ানো টিলাগুলো এখন অস্পষ্ট।
একসময় শিলং শহরে এসে ঢুকল পুলিশ-ভ্যান। পাইনপাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের কান্না বাজছে। সোঁ সোঁ দীর্ঘশ্বাস উঠছে। তারের জাল বসানো জানালার মধ্য দিয়ে বাইরে তাকাল সেঙাই।
দু’পাশ থেকে ঝলমলে আলোগুলো ছিটকে যাচ্ছে। সরে সরে যাচ্ছে দোকান পসার, বিচিত্র চেহারার মানুষ, বিচিত্রতর বেশভূষা।
ভ্যানটা ছুটছে, তার শ্রান্ত হৃৎপিণ্ডের একটানা ঘসঘস শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই সেটা বিরাট এক ফটকের মধ্যে ঢুকে গেল।
রেলের ঝকানি, ভ্যানের দোলানি এবং দু’দিনের অবিশ্রান্ত ধকলে শরীরটা যেন কেমন করে উঠল। কাঁধ থেকে আঙুলের ডগা পর্যন্ত সমস্ত ডান দিকটা ফুলে রয়েছে। অসহ্য টাটানি শুরু হয়েছে। সেঙাই-এর মনে হল, ডান দিকটা খসে পড়বে। একটা যন্ত্রণার থাবা ক্রমাগত মাংস শিরা-উপশিরাগুলোকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধরেছে যেন। এই দু’দিন খানিকটা ঝলসানো মাংস, একচোঙা রোহি মধু আর একপিণ্ড গলা ভাত ছাড়া পেটে কিছুই পড়েনি। হঠাৎ ভ্যানের মধ্যে পিত্তবমি করে ভাসিয়ে দিল সে। তার পরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এই শিলং পাহাড়, হুস হুস করে ছুটে যাওয়া আলোকিত বাড়িঘর আর পাইনবন তার চেতনা থেকে মুছে গেল।
যখন জ্ঞান ফিরল, চারিদিকে ছায়া ছায়া, ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকার। একটা মুখ তার মুখের কাছে ঝুঁকে রয়েছে। একপাশে তেলের লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে। ঘোর ঘোর, সন্দিগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সেঙাই চমকে উঠল। উঠে বসতে চাইল। কিন্তু তার আগেই দুহাতের সস্নেহ চাপে আবার শুয়ে পড়ল সে।
আশ্চর্য! মানুষটা কথা বলছে না। তবু স্ফুটনোম্মুখ মনের সমস্তটুকু বোধ দিয়ে সেঙাই বুঝতে পারল, এর দিক থেকে বিপদ-আপদের কোনো সম্ভাবনা নেই। আচ্ছন্ন এবং বিহ্বল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল।
চোখ থেকে আচ্ছন্নতা কেটে গেল একটু পরেই। সেঙাই দেখল, মানুষটা তার মতো নাগা নয়, সমতলের বাসিন্দা। অথচ তাদের ভাষাটা কী সুন্দর রপ্ত করেছে। মানুষটা বলল, তুমি নিশ্চয়ই নাগা পাহাড় থেকে এসেছ। কী নাম তোমার?
হু-হু, আমি নাগা। কেলুরি বস্তিতে আমাদের ঘর, আমাদের বংশ হল জোহেরি, আমার নাম সেঙাই। একটু থেমে সেঙাই আবার বলল, তুই কে?
আমি? আমার নাম বসন্ত সেন। মুখখানা আরো ঝুঁকিয়ে দিলেন বসন্ত। বললেন, তুমি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলে। এখন কেমন লাগছে?
বসন্তর কথার উত্তর দিল না সেঙাই। ফিসফিস করে বলল, তুই তো আসা। আমাদের পাহাড়ীদের কথা কী করে শিখলি?
স্নিগ্ধ হেসে বসন্ত বললেন, অনেকদিন আমি নাগা পাহাড়ে ছিলাম। কোহিমা, ডিমাপুর, মোককচঙ, ওখা, তুয়েন সাঙ–তোমাদের পাহাড়ের সব জায়গায় ঘুরেছি। ঘুরতে ঘুরতে তোমাদের কথা শিখে ফেলেছি। একটু ছেদ, আবার শুরু হল, তুমি এই জেলখানায় এলে কেন?
জেলখানা কী?
যেখানে মানুষকে আটক করে রাখা হয়।
আটকে রাখবে কেন?
দোষ করলে, কাউকে মারলে ধরলে, খুনখারাপি করলে, চুরি করলে আটকে রাখে। তুমি কী করেছিলে?
সেঙাই সোৎসাহে বলতে শুরু করল, আমাদের পাহাড়ে একটা রানী আছে, তার নাম গাইডিলিও। রানী বলত, নাগা পাহাড়ে সায়েবরা সদ্দারি করতে এসেছে। আমরা শয়তানদের সদ্দারি মানব না।
ঠিক, ঠিক কথা। আগ্রহে চোখ দুটো ঝকমক করতে লাগল বসন্তর। আরো একটু এগিয়ে ঘন হয়ে বসে বললেন, তারপর?
ভাবলাম, রানীর কথামতো আমরা কাজ করব। সায়েবদের সদ্দারি মানব না, ফাদারদের নিমক কাপড় নেব না, যীশু-মেরী বলব না, ক্রন্স আঁকব না। সায়েবরা রেগে রানীকে খুঁজতে এল আমাদের বস্তিতে। আমরা রুখতে গেলাম। শয়তানের বাচ্চারা আমাদের বস্তি জ্বালিয়ে। দিল। বন্দুক দিয়ে ফুঁড়ল। তারপর বেঁধে নিয়ে এল এখানে। এই দ্যাখ, আমার কী হাল করেছে! ফুঁসতে ফুঁসতে ডান হাতখানা দেখাল, আমাদের বস্তির জামাতসুর পেটে বাচ্চা ছিল, তাকে পেটে লাথি মেরে শয়তানেরা খতম করেছে। আমার ঠাকুমার বুক ফুঁড়ে সাবাড় করেছে। মেহেলীকে কেড়ে নিয়ে গেছে। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বসন্তকে আঁচড়াতে কামড়াতে লাগল সেঙাই।
পাহাড়ী মানুষের আক্রোশ এবং যন্ত্রণা প্রকাশের রীতি জানতেন বসন্ত। তাই বিচলিত হলেন না। অন্যমনস্কের মতো বললেন, মেহেলী কে?
আমার পিরিতের জোয়ানী। পনেরো দিন পরে আমার সঙ্গে মেহেলীর বিয়ের কথা ছিল। রামখোর বাচ্চারা ওকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। সেঙাই কাঁদতে লাগল।
সেঙাই-এর কান্না বসন্তকে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তিনি ভাবছিলেন অন্য কথা। শান্ত, স্নিগ্ধ মানুষটির প্রাণ টগবগ করে ফুটছিল। তিনি ভাবছিলেন, আসমুদ্রহিমাচল বিশাল বিপুল এই দেশ, তার আত্মা, মনুষ্যত্ব এবং আকাঙ্ক্ষার মধ্যে স্বাধীনতা নামে যে প্রখর চেতনার জন্ম হয়েছে, তা থেকে এই দেশের একটি মানুষও বিচ্ছিন্ন হয়ে নেই। স্বাধীনতার স্বপ্নে অরণ্যচারী, গুহাবাসী, আদিবাসী, উপজাতি–প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে উন্মুখ হয়ে রয়েছে।
বসন্ত ভাবছিলেন, এই চেতনাকে গুলি মেরে দাবিয়ে রাখা যাবে না। অন্যায় অবিচার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করার দিন শেষ হয়েছে। দেশে নতুন চেনা এসেছে নতুন উপলব্ধির আলো ছড়িয়ে পড়েছে।