হু-হু নিঘ্ঘাত শুনবি। সেঙাই সায় দিল, তারপর কী হল বল দিকি।
তারপর হুই শয়তানেরা রানীর খোঁজে বস্তিতে বস্তিতে যেতে লাগল। আমরা তাদের রুখলাম। তুইই বল, জান থাকতে আমরা রানীকে ধরিয়ে দিতে পারি?
না না, কক্ষনো না।
রানীকে আমরা ধরতে দিলাম না। রাগে সায়েবরা আমাদের বস্তি জ্বালিয়ে দিল, গুলি করে অনেককে ফুঁড়ল। এখন আমাদের কজনকে জখম করে শিলং পাহাড়ে নিয়ে চলেছে।
আচমকা সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, হুই শিলং পাহাড়ে আমরা যাব না। যাব না।
সেঙাই-এর সঙ্গে সঙ্গে অন্য জোয়ানেরা চিৎকার করতে লাগল, আমরা যাব না, যাব না।
বিশাল গোঁফে চাড়া দিয়ে বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি হুমকে উঠল, চুপ, চুপ কুত্তার বাচ্চারা।
গালাগালিটা নির্ভেজাল মাতৃভাষাতেই দিল বৈকুণ্ঠ।
সেঙাই-এর কাছাকাছি বসে জপমালা জপছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। এই শোরগোল, চিৎকার এবং তর্জন-গর্জনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নিজের চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল টেনে একান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সে।
.
৪৮.
মণিপুর রোড স্টেশন।
সকালবেলা রেলের কামরায় পাহাড়ী জোয়ানগুলোকে ঠেসে ঠেসে ভরে, পুলিশদের নিরঙ্কুশ হেফাজতে এবং রাইফেল বেয়নেটের জিম্মায় রেখে কোহিমার দিকে ফিরে গেল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।
সেঙাইদের সঙ্গে গেল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি।
বিস্মিত, বিহ্বল হয়ে রেলগাড়ি দেখল সেঙাই। অন্য ছেলেরাও দেখল। এর আগে তারা রেলগাড়ি দেখেনি। ভীতি, উৎকণ্ঠা এবং প্রবল ঔৎসুক্যের মিশ্র অনুভূতিতে চুপচাপ বসে রইল সকলে।
একসময় ঝকর ঝকর শব্দ করে ট্রেন ছুটতে শুরু করল। জানালার ফাঁক দিয়ে পাহাড়ী বুনো দেশ ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমতলের বাসিন্দাদের নানা ধরনের, বিচিত্র আকারের সব ঘরবাড়ি মিলিয়ে যেতে লাগল। পাশে পাশে টেলিগ্রাফের তার।(ওগুলো যে টেলিগ্রাফের তার, আট বছর পরে তা জেনেছিল সেঙাই)। রাঙ্গা পাহাড়, ডিফু, লামডিঙ, চাপার মুখনানা স্টেশন।(স্টেশন এবং স্টেশনগুলোর নামও আট বছর পরেই জেনেছিল সেঙাই। আট বছরে স্টেশনের নাম এবং টেলিগ্রাফের তারই শুধু নয়, আরো অনেক বিস্ময়কর বস্তু এবং মানুষ দেখেছিল সেঙাই! অসংখ্য ব্যাপার বুঝেছিল। জীবনের অনেক মৌল সমস্যা তাকে নাড়া দিয়েছিল। সে-সব অনেক পরের কথা। যখাসময়ে বলা যাবে)। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের বিরাম। নানা চেহারার মানুষের জটলা। এক একটা স্টেশন আসে। শুরু হয় হইচই, চিৎকার, যাত্রীদের ওঠানামা। তারপর আবার দৌড়।
পাহাড়ী বুনো মানুষ সেঙাই-এর অস্ফুট মনটা বিস্ময়ে ঝুঁদ হয়ে গেল। অবাক, নিষ্পলক চোখে সে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়ের জন্য চলমান বনজঙ্গল, সমতলের দেশ, এ দেশের বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে কবজির যন্ত্রণা, মেহেলী, কেলুরি গ্রাম, গাইডিলিও, এবং অতীতের সব কথাই যেন ভুলে গেল সেঙাই।
শিলং পাহাড়ে যেতে চাইছিল না সেঙাই। চিৎকার করেছিল, রাগে ফেটে পড়েছিল। এখন শিলং যাওয়ার পথটা এবং রেলগাড়ির একটানা ঝকানি মোটামুটি মন্দ লাগছে না। নাগা পাহাড়ের বাইরে এমন একটি সুন্দর দেশ যে ছিল তা কি আগে জানত সেঙাই?
জানালার সামনে পাহাড়ী জোয়ানেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
একজন বলল, এটাই বুঝি আসান্যুদের দেশ?
হু-হু– সেঙাই মাথা ঝাঁকায়।
দেশটা ভালো, খুব ভালো।
হু-হু, দেখছিস আমাদের ঘরের চেয়ে আসাদের ঘরগুলো অনেক ভালো।
হু-হু, ঠিক বলেছিস। সকলে সায় দিল।
সেঙাই বলল, শিলং থেকে বস্তিতে ফিরে এইরকম ঘর বানাব।
কে, তোর ঘর নেই? বিয়ে হয়নি?
বেশ ভুলে ছিল সেঙাই, আবার মেহেলীর কথা মনে পড়ল। চোখজোড়া জ্বলে উঠল তার। সে ফুঁসে ওঠে, টেমে নটুঙ! বিয়ে আর হল কই? মোরাঙ থেকে বেরুতেই পারলাম না। বিয়ে করার আগেই তো শয়তানের বাচ্চারা মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। আমাকে ছুঁড়ল। টেফরা ঘর বানাতে দিল না।
হঠাৎ হাউ হাউ করে সেঙাই কেঁদে উঠল।
কত সাধ ছিল তার, অপরিণত মনে কত স্বপ্নই না ঠাসা ছিল। সমস্ত চেতনা জুড়ে স্পষ্ট অস্পষ্ট কত কামনাই না ছিল। বিয়ের পর মেহেলীকে নিয়ে ঘর বেঁধে থাকবে। জোরি বংশের বাড়িটার পাশে সর্দার তাকে ঘর তোলার জায়গা দিয়েছিল। বিয়ের সময় ফসলের, জন্মমৃত্যুর, বনপাহাড়ের আনিজাদের নামে সাদা শুয়োর বলি দেবে। গ্রামের সবাইকে ভোজ খাওয়াবে। নিজের ধরনে মনে মনে স্থূল ভোগ এবং উপভোগের জগৎ বানিয়ে নিয়েছিল সেঙাই। কিন্তু সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে গেল। তাকে সাহেবরা চালান করছে শিলং-এ, মেহেলী যে কোথায়, কতদূরে, তার হদিস কেই বা দেবে এখন?
সেঙাই কাঁদছে। চুল ছিঁড়ে আশেপাশের জোয়ানদের আঁচড়ে কামড়ে শব্দ করে চেঁচাচ্ছে।
আদিম মানুষের কামনার প্রকাশ যেমন সাঙ্ঘাতিক, তার নৈরাশ্যও তেমনই মারাত্মক।
সেঙাই-এর বিচিত্র ধ্বনিময় কান্না মুহূর্তে অন্যান্য জোয়ানদের স্পর্শ করল। তারাও সমস্বরে কান্না জুড়ে দিল।
গাড়ির দোলানিতে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জির। দুটো দিন পাহাড়ীদের গ্রামে হানা দিয়ে কি ধকলটাই না গিয়েছে! তন্দ্রার ব্যাঘাত ঘটায় দাঁত খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বৈকুণ্ঠ, থাম জানোয়ারের বাচ্চারা।
.
ট্রেনের চাকার নিচে রেলের লাইন ফুরিয়ে এল। গুয়াহাটি স্টেশন। সেখান থেকে আবার পুলিশ-ভ্যানে শিলং পাহাড়। মাঝে ডিমাপুরের পথের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী সড়ক। সেই সড়ক ধরে যেতে যেতে রাত্রি নামল।