হু-হু– সেঙাই মাথা নাড়ল।
সত্যিই তো, মন খারাপ হবার কথাই। কিন্তু উপায় কী? মুখখানায় একটা খাঁটি জাতের বিমর্ষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল ম্যাকেঞ্জি।
আচমকা দুর্বল দেহের অবশিষ্ট শক্তি কোমরে একত্র করে উঠে বসল সেঙাই। হাউ হাউ করে ডুকরে উঠল, তুই আমাকে মেহেলীর কাছে দিয়ে আয় সায়েব।
মেহেলীর কাছে যেতে চাইছ?
হু-হু—
মেহেলীর কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তার আগে তুমি আমাকে আর একজনের কাছে নিয়ে যাবে। যদি তার কাছে নিয়ে যেতে পার তা হলে মেহেলীর সঙ্গে তেলেঙ্গা সু মাসেই তোমার বিয়ে দেব। বলতে বলতে চোখ দুটো তীক্ষ্ণ করে সেঙাই-এর মুখের ভাবভঙ্গি লক্ষ করতে লাগল ম্যাকেঞ্জি।
কে সে? কার কাছে তোকে নিয়ে যাব?
ম্যাকেঞ্জির মুখে স্বৰ্গীয় হাসি ফুটল, তোমাদের ওই রানী গাইডিলিওর কাছে। আমার বড় ব্যারাম হয়েছে। সে ছুঁয়ে দিলে সেরে যাবে।
সন্দিগ্ধ চোখে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকিয়ে সেঙাই বলল, তুই তো রানীকে ডাইনি বলিস। তার কাছে যে আবার ব্যারাম সারাতে চাইছিস!
তোমাকে রাগাবার জন্যে বলি। ওসব কথা থাক, তুমি আমাকে রানীর কাছে নিয়ে চল।
রানীকে কোথায় পাব? সে আমাদের বস্তি থেকে চলে গেছে।
তবে মেহেলীকেই বা আমি কোথায় পাব? সে তো নাগা পাহাড় থেকে ভেগেছে।
সেঙাই হুমকে উঠল, ইজা হুবতা! তোকে বর্শা দিয়ে ফুড়ব। তুই আমাকে বস্তিতে রেখে আয়।
বস্তিতে ফিরতে চাও? ঠিক আছে, আট বছর পর ফিরো। কেমন? ম্যাকেঞ্জির কণ্ঠ বড় স্নেহময় শোনাল।
আট বছর! আট বছর আমি কোথায় থাকব?
শিলং পাহাড়ে।
শিলং পাহাড়ে যাব না, কিছুতেই না। সেঙাই ফুঁসে উঠল।
কী মুশকিল! সেখানে তোমার জন্যে একখানা ঘর তৈরি করে রেখেছি যে। না গেলে কি চলে? বিরক্ত হতে হতে নিজেকে সামলে নিয়ে, হেসে ফেলল ম্যাকেঞ্জি।
শিলং! নামটা এর আগেও বারকয়েক শুনেছে সেঙাই। মাথোলাল, সারুয়ামারু এবং তার বাপ সিজিটো তাকে বলেছে। ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে কোথায় শিলং নামের অদ্ভুত রহস্যময় দেশটা রয়েছে, অতশত খবর জানে না সেঙাই। শিলং তার অস্ফুট মনটাকে দুর্বোধ্য আকর্ষণে হয়তো টেনেছে। আগে ওই জায়গাটার জন্য কিছুটা কৌতূহলও তার হয়ে থাকবে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে শিলং সম্বন্ধে তার কোনো মোহ নেই, কৌতূহল থাকলেও উবে গিয়েছে।
অপরিণত মন দিয়ে সেঙাই অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে, মাধোলাল, সারুয়ামারু কি তার বাপ সিজিটোর শিলংয়ের সঙ্গে ম্যাকেঞ্জির শিলংয়ের বিন্দুমাত্র মিল নেই। ম্যাকেঞ্জির শিলংয়ের সঙ্গে দুর্বোধ্য বিভীষিকা এবং আশঙ্কা যেন জড়িয়ে রয়েছে। সেখানে গেলে সে আর বাঁচবে না। নির্ঘাত মরে যাবে। আনিজার গোসা এসে পড়বে। শিলং পাহাড়ে সে যাবে না, কিছুতেই না। মেহেলীকে ছেড়ে, নিজেদের বন্ধুবান্ধব প্রিয়জন, কেলুরি গ্রামের চারপাশের নদী, বনভূমি, ফসলের খেত এবং শিকারের সঙ্গী, সবার ওপর অভ্যস্ত বন্য জীবন ছেড়ে অজানা শিলং পাহাড়ে আটটা বছর কাটাতে হবে! ভাবতেও মনটা অসাড় হয়ে আসে।
নাগাপাহাড় তাকে সব দিয়েছে। আলো বাতাস দিয়েছে, ঝরনার জল দিয়েছে, স্বাস্থ্য-খাদ্য আয় দিয়েছে। মা বাপ-ভাই-বোন, পিরিতের জোয়ানী থেকে শুরু করে নগদা উৎসব, ফসল বোনার উৎসব, জঙ্গল কাটার উৎসব, শিকারের জন্য হিংস্র জানোয়ার, পাহাড়ী আরণ্যক মানুষের বেঁচে থাকার মতো প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণই দিয়েছে। না না, চিরকালের চেনা জগৎ ছেড়ে সে কোথায়ও যাবে না।
সেঙাই চিৎকার করে উঠল, আমি যাব না, কিছুতেই যাব না শিলং পাহাড়ে। আমাকে ছেড়ে দে সায়েব, বস্তিতে ফিরে যাই।
ম্যাকেঞ্জি কিছুই বলল না। শুধু সেই অপার্থিব হাসিটুকু সমস্ত মুখে স্থির করে রাখল।
পাহাড়ী সড়ক বেয়ে পুলিশ ভ্যানটা ডিমাপুরের দিকে ছুটে চলেছে। সেই সঙ্গে ছুটছে। সেঙাই-এর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, আমি যাব না শিলং পাহাড়ে। যাব না। নানা-না।
কিছুক্ষণ পর অস্থিরতা খানিকটা কাটলে সামনের একটা জোয়ানের দিকে তাকাল সেঙাই। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে। সেঙাই ডাকল, এই, তুই কে?
জোয়ানটা মাথা তুলল। চোখের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে যেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে।
সেঙাই আবার বলল, তুই কে?
আমি লেঙড়ি আও। ফচিমাঙ বস্তিতে আমাদের ঘর।
এবার ওপাশের অন্য একটা জোয়ানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে সেঙাই জিগ্যেস করল, তুই কে? তোদের কোন বস্তি?
আমি ইয়ালুলুক। আমাদের বস্তি হল জুনোবট।
একটি একটি করে প্রতিটি জোয়ানের নাম-ধাম-গোত্রবংশের খবর নিল সেঙাই। কেউ কোনিয়াক, কেউ আও, কেউ সাঙটাম, কেউ রেঙমা–নাগা পাহাড়ের দিগদিগন্ত থেকে, নানা গ্রাম-জনপদ থেকে, এইসব পাহাড়ী ছেলেদের তুলে নিয়ে এসেছে ম্যাকেঞ্জিরা।
সেঙাই বলল, সায়েব শয়তানের বাচ্চারা তোদের ধরে আনল কেন রে?
জোয়ানেরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কেন আবার? রানী গাইডিলিও আমাদের বস্তিতে গিয়েছিল। কত কথা বলেছে রানী। বলেছে, ছয় আকাশ আর ছয় পাহাড়ের ওধারে কোন এক ভিন দেশ থেকে সায়েব শয়তানরা এসেছে সদ্দারি ফেলাতে। বলেছে, আমাদের পাহাড় থেকে রামখোর বাচ্চাদের ভাগিয়ে দিতে হবে। আমরা রানীর কথামতো কাজ করলাম। সায়েবদের কাছ থেকে নিমক নিই না, যীশু-মেরী বলি না, বুকে কাঁধেকপালে আঙুল ঠেকাই না। কেন রানীর কথা শুনব না? ওর ছোঁয়ায় ব্যারাম সারে, আনিজার গোসা চলে যায়। ওর কথা নিঘ্ঘাত শুনব।