সেঙাই চোখ মেলল। চোখজোড়া টকটকে লাল। আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। সব ঝাপসা, ছায়া ছায়া। অনেকক্ষণ পর ঘোরটা সামান্য কেটে গেলে শিউরে উঠল। বুকের মধ্যে ভীতি, শঙ্কা এবং উত্তেজনা কিলবিল করে ছুটতে লাগল যেন।
কোহিমা থেকে ডিমাপুরের দিকে পুলিশ ভ্যানটা সাঁ সাঁ ছুটছে। মাঝখানে সেঙাই শুয়ে রয়েছে। আশেপাশে জনকয়েক পাহাড়ী জোয়ান হাঁটু গুঁজে দলা পাকিয়ে বসে আছে। লোহার বেড়ি দিয়ে তাদের হাত-পা বাঁধা। কারো মাথার খুলি ফাটা, কারো উরু ভেদ করে গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। কারো আবার ধারাল বেয়নেটের খোঁচা লেগে খাবলা-খাবলা মাংস উঠে গিয়েছে। পাহাড়ী জোয়ানগুলির শরীরে জমাট বাঁধা রক্ত।
ঘোর ঘোর দৃষ্টিটা সকলের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল সেঙাই। চেনাজানা একজনও বেরুল না। তাদের কেলুরি গ্রামের একটা মানুষও নেই পুলিশ ভ্যানটার মধ্যে।
এবার নিজের ডান হাতের কবজিটার দিকে তাকাল সেঙাই। তাকিয়েই চমকে উঠল। ক্ষতমুখে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে রয়েছে। কাধ পর্যন্ত সমস্ত হাতখানা অস্বাভাবিক ফুলেছে। ক্ষতমুখ থেকে লালচে বিষাক্ত রস ঝরছে। অসহ্য যন্ত্রণায় দেহ থেকে হাতখানা যেন খসে পড়বে। নির্জীব গলায় সেঙাই আর্তনাদ করে উঠল, আ-উ-উ-উ-উ, আ-উ-উ-উ-উ—
জনকতক পুলিশ জোয়ানগুলোকে ঘিরে বসেছে। তাদের হাতে রাইফেল, রাইফেলের মাথায় বেয়নেটের শাণিত ফলাগুলো কী হিংস্র!
সামনের দিকে উবু হয়ে বসেছে বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। তার পাশে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। ম্যাকেঞ্জির কণ্ঠায় সেঙাই-এর বর্শা গেঁথে গিয়েছিল। এখন সেখানে মোেটাসোটা বিরাট এক ব্যান্ডেজ।
তার-আঁটা জানলার ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাল সেঙাই। কিছুদিন আগে সারুয়ামারুর সঙ্গে এই কোহিমা পাহাড়ে এসেছিল, সে স্মৃতিটা এখনও টাটকা।
ডিমাপুরগামী এই পথটার পাশে বিকিকিনি, লেনদেনের বাজার বসিয়েছে সমতলের বাসিন্দারা। সারুয়ামারু এখানে নিয়ে এসেছিল তাকে। মাথোলালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেঙাই-এর। মাধোলাল! অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলত সে। আসাদের সর্দার গান্ধির গল্প, রানী গাইডিলিরও গল্প। ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে অজানা দেশের বিচিত্র সব মানুষের, তাদের বিস্ময়কর জীবনযাত্রা, রীতিনীতি এবং আচার আচরণের গল্প বলত। রহস্যময় দুর্বোধ্য নেশায় সেঙাই বুঁদ হয়ে থাকত।
হঠাৎ দৃষ্টিটা চমকে উঠল সেঙাই-এর। ডেমাপুরগামী সড়কের সেই বাজারটার চিহ্নমাত্র নেই। সমতলের বাসিন্দারা, তাদের চাল-ডাল-নুন, তেল-হেরিকেন থেকে শুরু করে নানা মনিহারী পণ্যসম্ভার কি এক ভোজবাজিতে উধাও হয়েছে। মাধোলালের সেই দোকানটা, বাঁশের মাচান, টিনের চাল, কাঠের দেওয়াল ভেঙেচুরে ছত্রখান হয়ে রয়েছে। শুধু মাথোলালের দোকানই নয়, সমতলের বাসিন্দাদের এই বাণিজ্যমেলাকে দলে পিষে ভেঙে মুচড়ে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।
বিড়বিড় গলায় সেঙাই বলল, মাধোলাল, মাধোলাল–
আঁকাবাঁকা পথটা ধরে, কখনও টিলার ওপর দিয়ে, কখনও পাহাড়ের চূড়ার পাশ দিয়ে নিবিড় বনভূমি চিরে চিরে এগিয়ে চলেছে পুলিশ ভ্যানটা। কখনও সড়কটা দোল খেয়ে সামনের দিকে নেমে গিয়েছে, আবার খাড়া চড়াই বেয়ে ওপরের দিকে উঠেছে। চোখের সামনে থেকে ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে জলপ্রপাত, ঘন বন, ঝরনা, টিলা, খাদ।
বাইরে থেকে দৃষ্টিটাকে ভ্যানের মধ্যে নিয়ে এল সেঙাই। ধারাল কটা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ম্যাকেঞ্জি। নির্বিকার ভঙ্গিতে বিডস জপে চলেছে।
বাঁ হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চাইল সেঙাই। কিন্তু যন্ত্রণায় সমস্ত শরীরটা যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। সামান্য ঝাঁকানি লেগে মনে হল, ডান হাতটা বুঝি ছিঁড়ে পড়বে। আধাআধি উঠেই আবার শুয়ে পড়ল সেঙাই।
ম্যাকেঞ্জি বলল, কি সেঙাই, ঘুম ভাঙল?
প্রথমে জবাব দিল না সেঙাই। একটু পর দুর্বল গলায় গর্জে উঠল, ইজা হুবতা! এই শয়তানের বাচ্চা, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
বিচিত্র এক হাসির মহিমায় মুখখানা ভরে গেল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। আশ্চর্য শান্ত গলায় সে বলল, তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি সালুয়ালাঙ বস্তিতে। তোমার সঙ্গে যে আজ মেহেলীর বিয়ে হবে।
সব মিছে কথা। সালুয়ালাঙ তো আমাদের কেলুরি বস্তির পাশে। আর এটা তো কোহিমা শহরের পথ। বলে একটু দম নিয়ে সেঙাই ফের বলল, সালুয়ালাঙের সদ্দারকে সাবাড় করেছিস। তাদের বস্তিতে গেলে তোদের খতম করবে।
বিন্দুমাত্র ভাবান্তর ঘটল না ম্যাকেঞ্জির। মুখের হাসিটা স্থানচ্যুত হল না। অস্ফুট গলায় স্বগত ভঙ্গিতে বলতে লাগল সে, নাড়িজ্ঞান একেবারে টনটনে। শয়তানটা ঠিক টের পেয়েছে এটা সালুয়ালাঙে যাবার পথ নয়।
সেঙাই চেঁচাল, আহে ভু টেলো! তোদের খুব ফুটানি হয়েছে। আমাকে ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস সেই কথাটা বল না টেফঙের বাচ্চা। দাঁড়া, হাতটা একটু ভালো হতে দে। তোদের সব সদ্দারি বর্শা হাঁকড়ে লোপাট করব। একবার বর্শা দিয়ে তোর গলা কুঁড়েছিলাম, তখন তুই মরিসনি। এবার তোকে নিঘাত খুন করব।
মুখের একটা রেখাও বিকৃত হল না ম্যাকেঞ্জির। জপমালার গায়ে আঙুলগুলো এতটুকু বিচলিত হল না। ধীর, শান্ত গলায় সে বলল, আমাকে খুন করতে চাইছ সেঙাই? খুব ভালো, খুব ভালো। কিন্তু হাতটা জখম হয়ে রয়েছে। এখন তো পেরে উঠবে না। ওষুধ দিয়ে হাতটা সারিয়ে একটা বর্শা দেবখন। তখন আমাকে ছুঁড়ো। তার আগে একটা কথা জিগ্যেস করি। ঠিক ঠিক জবাব দাও দিকি। বলতে বলতে মুখখানা কানের কাছে নামিয়ে আনল ম্যাকেঞ্জি। বলল, মেহেলীর জন্যে মনটা খুব খারাপ লাগছে, তাই না সেঙাই?