ধারাল দাঁত এবং তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে কামড়ে আঁচড়ে পুলিশদের জামা ছিঁড়ে ফেলল জামাতসু। গা-হাত কেটে ফেঁড়ে একাকার করে দিতে লাগল। পুলিশগুলো আকস্মিক আক্রমণে বিহ্বল এবং হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। ওপাশ থেকে বসওয়েল দৌড়ে এল। বিরাট থাবায় জামাতসুর চুলের গোছা শক্ত করে ধরে পুলিশদের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, ওম্যান, ডোন্ট ডু সো।
পিঙ্গল চোখ দুটো রক্তাভ হয়ে উঠেছে জামাতসুর। বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। রাগে উত্তেজনায় সমস্ত দেহ দুলছে, কাঁপছে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। পুলিশ সুপার বসওয়েলের চোখেমুখে কী এক ছায়া দেখে জামাতসু হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ইজা বুতা! চেঁচাতে চেঁচাতেই বসওয়েলের বুকের ওপর লাফিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল।
চুলের গোছা ধরাই ছিল। এক টানে জামাতসুকে বুক থেকে সরিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত পিষল বসওয়েল। চোখ দুটো জ্বলছে। চিবিয়ে চিবিয়ে নির্মম গলায় সে বলল, ওম্যান, ইউ আর প্রেগনান্ট। পাহাড়ী রীতিতে তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধে। বাট আই অ্যাম ব্রিটিশার, নো হিল বিস্ট। তুমি আমাদের কাজে বাধা দিচ্ছ। আমার জ্ঞানে এবং বিচারে এ রীতিমতো অপরাধ। অ্যান্ড ফর দ্যাট–বলতে বলতেই গর্ভিণী জামাতসুর স্ফীত পেটে ভারী বুটের প্রচণ্ড লাথি বসিয়ে দিল।
আর্তনাদ করে পাথুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল জামাতসু, আ-উ-উ-উ-উ–
সঙ্গে সঙ্গে মণিপুরী পুলিশদের কাঁধের ওপর থেকে সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, শয়তানের বাচ্চা জামাতসুকে খতম করে ফেলল। ওটাকে সাবাড় কর।
বসওয়েলকে সাবাড় করবার মতো সবল, শক্তিমান একটা পাহাড়ী জোয়ানও আশেপাশে নেই।
রক্তের সমুদ্রে ছটফট করছে জামাতসু। গড়াগড়ি দিতে দিতে তার দেহটা কখনও ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে, পরক্ষণেই টান টান হচ্ছে। খানিক পর একেবারেই থেমে গেল জামাতসু, পুরোপুরি নিস্পন্দ হয়ে গেল।
আর বসওয়েল উন্মাদ গলায় অট্টহাসি হাসছে, হাঃ-হাঃ-হাঃ–
ওপাশ থেকে সালুয়ালাঙের সর্দার গর্জে উঠল, ইজা বু! শয়তানের বাচ্চা সায়েব, তুই পোয়াতি মাগীকে খতম করলি! আমাদের ওপর আনিজার গোসা হবে না? বলেই বর্শা তুলে তাক করল।
ম্যাকেঞ্জি চিৎকার করে উঠল, বর্শা ছুড়ো না সর্দার, খবরদার। সায়েব তো ভালোই করেছে। তোমাদের শত্রুকে খতম করেছে।
আহে ভু টেলো! শর বলে পোয়াতি মাগীকে সাবাড় করবে! এ পাপ সইব না। শয়তানের বাচ্চাটাকে ছুঁড়বই। বর্শাটা ছোঁড়ার উদ্যোগ করল সালুয়ালাঙের সর্দার।
কিন্তু তার আগেই বসওয়েলের রিভলভার থেকে এক ঝলক নীল আগুন ছুটে গেল, বু-ম্-ম্-ম্–
পাঁজরে হাত চেপে বিকৃত আর্তনাদ করে দুমড়ে মুচড়ে পাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সালুয়ালাঙের সর্দার।
নানকোয়া আর সালয়ালা গ্রামের জোয়ানরা মেহেলীকে নিয়ে অনেক আগেই টিজু নদীর দিকে চলে গিয়েছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেলীর বাপ সাঞ্চামখাবা, রাঙসুঙ এবং মেজিচিজুঙ। কেউ কিছু করার বা বলার আগে তিনজনে লাফ দিয়ে টিলার মাথা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ল। সেখান থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বসওয়েল আবার অমানুষিক অট্টহাসি জুড়ে দিল, হাঃ-হাঃ-হাঃ–আমাকে বর্শা হাঁকাতে চায় পাহাড়ী কুত্তাটা! গ্রেট ওয়ার–
থামুন। ভয়ানক গলায় ধমক দিল ম্যাকেঞ্জি, কী সর্বনাশটা করলেন বলুন দিকি?
বসওয়েলের হাসি থেমে গিয়েছে। কঠিন গলায় টেনে টেনে সে বলল, কী সর্বনাশ করলাম?
পাহাড়ীটাকে ছুঁড়ে আমাদের ইন্টারেস্টের দিক থেকে কত ক্ষতি হল জানেন? কুঞ্চিত চোখে তাকিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলতে লাগল, ওর কাছ থেকে গাইডিলিওর খবর পাওয়া যেত। একে তো সমস্ত নাগা পাহাড়টা আমাদের ওপর খেপে রয়েছে। ভালোভাবে প্ৰিচ করতে পারছি না। তার ওপর লয়াল পাহাড়ীদের খুন করলে উপায় থাকবে? একটু ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে কাজ করতে হয়।
রিভলভারের মাথায় আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বোকা বোকা মুখ করে বসওয়েল বলল, কিন্তু শয়তানটা যে বর্শা ছুড়ত!
ছুড়ত না। আমি ছুঁড়তে দিতাম না। যদি ছুড়ত আপনি মরতেন। ওকে মেরে হয়তো আপনার প্রাণ বাঁচল, কিন্তু ওটা বেঁচে থাকলে গাইডিলিওকে তাড়াতাড়ি ধরা যেত, নাগা পাহাড়ে ব্রিটিশ রুল আরো জাঁকিয়ে বসত। যাক, এমন ভুল আর কক্ষনো করবেন না মিস্টার বসওয়েল। সবসময় খুনখারাপিতে কাজ হয় না। এই তো সেঙাই আমাকে বর্শা দিয়ে জখম করল। আমি ওকে মারলাম? না, ওকে মারবই না। ওর কাছ থেকে গাইডিলিওর খবর আদায় করতে হবে না?
নিচের দিকে মাথাটা ঝুলিয়ে অল্প অল্প নাড়তে লাগল বসওয়েল। ম্যাকেঞ্জির প্রতি শ্রদ্ধার মাত্রাটা হঠাৎ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে সে বলল, আমি অতটা তলিয়ে দেখিনি।
দুর্বোধ্য হাসি হাসল ম্যাকেঞ্জি। সেই সঙ্গে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলল, মানুষ মাত্রেরই ভুলচুক হয় মিস্টার বসওয়েল। যা হবার হয়ে গেছে। এখনই কোহিমা ফিরতে হবে। সালুয়ালাঙে তো যাবার উপায় নেই। পাহাড়ী তিনটে ছুটে পালাল। মেরেছিলেন যখন, ওই কটাকেও যদি শেষ করতেন। যাক, নির্ঘাত ওরা তোক ডেকে আনবে। ওরা এসে পড়ার আগেই আমাদের সরে পড়তে হবে। কুইক।
.
৪৭.
সমস্ত রাত বেহুশ হয়ে ছিল সেঙাই। যখন জ্ঞান ফিরল, কোহিমা পাহাড়ের আকাশ থেকে সাঙসু ঋতুর তাপহীন বিকেলটা নিভে আসতে শুরু করেছে। আকাশ সাঁতার ক্লান্ত পাখিদের ঝক কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে।