হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—
হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—
আকাশ-ফাটানো শোরগোল শুরু হল।
তারপরেই জনকয়েক জোয়ান ছেলে মেহেলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। জামাতসু বাধা দিতে এগিয়ে এসেছিল। তাকে ধাক্কা মেরে, গুতিয়ে এক পাশে ফেলে দিয়েছে একটা জোয়ান। দুহাতের কঠিন বাঁধনে সেঙাইকে জড়িয়ে, তার বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে মেহেলী। নিমেষে সেঙাই-এর বুক থেকে মেহেলীকে ছিনিয়ে কাঁধের ওপর তুলে নিল জোয়ানেরা। উতরাই বেয়ে তারা ছুটল টিজু নদীর দিকে। একটা ভয়ঙ্কর পাহাড়ী ঝড় যেন ছুটে চলেছে।
হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ—
হোয়া-য়া য়া-আ-আ—
তুমুল উল্লসিত চিৎকার আকাশের দিকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে লাগল।
প্রাণ-ফাটা আর্তনাদ করে উঠল মেহেলী। সে আর্তনাদে ছয় আকাশ, ছয় পাহাড় এবং বন ঝরনা-প্রপাত দিয়ে ঘেরা এই নাগা পাহাড়ের হৃৎপিণ্ডটা যেন শিউরে উঠল। মেহেলীর আর্তনাদ জোয়ানদের সঙ্গে সঙ্গে যেন ছুটে চলেছে, আ-উ-উ-উ-উ—আমি যাব না। শয়তানের বাচ্চারা, আনিজা ঘাড় মটকে তোদের রক্ত খাবে, খাদে ফেলে মারবে। আ-উ-উ-উ-উ–
হো-য়া-য়া-য়া-আ-আ–
হো-য়া-য়া-য়া-য়া-য়া-আ-আ–
নানকোয়া এবং সালুয়ালা গ্রামের জোয়ানদের উল্লসিত হল্লা দু’পাশের পাহাড়ে আছাড় খেতে খেতে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
টিজু নদীর দিকে মেহেলীর আর্তনাদ মিলিয়ে গেল। জোহেরি কেসুঙের পাথুরে উঠোন থেকে নির্জীব চোখে সেদিকে তাকিয়ে ছিল সেঙাই। কবজি ফুঁড়ে অনেক রক্ত ঝরেছে। অসহ্য যন্ত্রণার পর শরীরের বোধগুলি যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। হাত-পায়ের জোড়গুলো খুলে খুলে যাচ্ছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সেঙাই। তবু সে পাহাড়ী মানুষ। এদের আদিম দুর্দান্ত প্রকৃতি কবজির ক্ষত-মুখ দিয়ে খানিকটা রক্তপাতের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। শিরায় শিরায় হাড়-মেদ রক্তে যে বন্য হিংস্র প্রাণ প্রবল গতিবেগে সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে, সেটা এই মুহূর্তে উত্তেজনায় আক্রোশে প্রতিহিংসায় ফুঁসে ফুঁসে উঠতে লাগল। কোনোরকমে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসল সেঙাই। মাথা টলছে, শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। যন্ত্রণা এবং রাগে মুখখানা বিকৃত দেখাচ্ছে। বাঁ হাত বাড়িয়ে পাশের বর্শাটাকে তুলে নিল সে, তারপর শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সাঞ্চামখাবার দিকে ছুঁড়ে মারল। দুর্বল, অশক্ত দেহ। বর্শাটা সাঞ্চামখাবার ধারে কাছে পৌঁছল না।
সাঞ্চামখাবা বিকট শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, ইজা হুবতা! দ্যাখ দ্যাখ, সেঙাই। শয়তানটা বর্শা ছুড়ছে। কী তাগদ, আমার গায়ে ছোঁয়াতেই পারল না, আবার কুঁড়বার মতলব? বিড়বিড় করে অশ্রাব্য গালাগালি করতে করতে লুটিয়ে পড়ল সেঙাই। বসে থাকতে পারছে সে, কিন্তু চোখজোড়া জ্বলছে।
সাঞ্চামখাবা আঙুল বাড়িয়ে সেঙাইকে দেখিয়ে লাফাতে লাগল। হাসতে হাসতে চেঁচাল, রামখোর বাচ্চাটা বর্শা ছুঁড়েই কাত হয়ে পড়েছে। হিঃ হিঃ হিঃকী জোয়ান রে!
ডান হাতের কবজি কুঁড়ে একটা গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। সেই রক্তাক্ত, চূর্ণ, বিচূর্ণ শক্তিহীন হাতটার দিকে তাকিয়ে সেঙাই ককিয়ে উঠল, আ-উ-উ-উ-উ–আ-উ-উ-উ-উ—
.
বসওয়েল বলল, সমস্ত গ্রাম ঢুঁড়েও তো গাইডিলিওকে পাওয়া গেল না। এবার কী করা দরকার ফাদার?
ম্যাকেঞ্জি বলল, আপাতত আমরা ওই সালুয়ালা গ্রামে যাব। তার আগে সেঙাইটাকে বেঁধে নেওয়া দরকার। ওর সঙ্গে গাইডিলিওর নিশ্চয়ই যোগাযোগ রয়েছে। ওটার কাছ থেকে অনেক খবর পাওয়া যাবে, মনে হচ্ছে।
আর ইউ সুয়োর?
নিশ্চয়ই। আমার কথা বর্ণে বর্ণে মিলিয়ে নেবেন।
কী করে বুঝলেন সেঙাই-এর সঙ্গে গাইডিলিওর যোগাযোগ রয়েছে?
এটা কিন্তু পুলিশ সুপারের মতো কথা হল না মিস্টার বসওয়েল। গাইডিলিও এই গ্রামে ছিল। এ ব্যাপারে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই। তা ছাড়া সেঙাই নিজেই তো বলেছে, কোহিমায় ও যখন গিয়েছিল, আমরা ওকে ঠেঙিয়েছি, গাইডিলিও ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তবেই বুঝুন, আমরা স্বাভাবিক নিয়মেই সন্দেহ করতে পারি, গাইডিলিওর সঙ্গে এই গ্রাম আর সেঙাই-এর নিবিড় যোগ আছে। সন্দেহ যখন হয়েছে, একেবারে শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক না। সেঙাইকে খুঁচিয়ে, পিটিয়ে কিংবা ভালো কথা বলে এই হিল অ্যাজিটেশনের খবর জোগাড় করতেই হবে। শান্ত, দৃঢ় গলায় কথাগুলো বলে বিডস জপতে লাগল ম্যাকেঞ্জি।
শ্রদ্ধায় সম্ভ্রমে বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল বসওয়েল। এবার ফিসফিস করে বলল, আমি অতটা তলিয়ে দেখিনি। আপনি সত্যিই আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। তারপরেই ডান দিকে ঘুরে বসওয়েল হুঙ্কার ছাড়ল, চ্যাটার্জি, ওই শুয়ারের বাচ্চা সেঙাইটাকে আমাদের সঙ্গে নেবার ব্যবস্থা কর।
শিকারি কুকুরের মতো টিলার শেষ প্রান্তে ছুটে গেল বৈকুণ্ঠ চ্যাটার্জি। কোমরের বেল্টটাকে সামলাতে সামলাতে মণিপুরী পুলিশগুলোর দিকে তাকিয়ে চেঁচাল, ওটাকে কাঁধে তুলে নাও।
কয়েকটি মণিপুরী পুলিশ সেঙাই-এর রক্তাক্ত দেহটার দিকে এগিয়ে গেল।
এতক্ষণ একেপাশে দাঁড়িয়ে সাহেব আর পুলিশের ভাবগতিক লক্ষ করছিল জামাতসু। সেঙাইকে কাঁধের ওপর তোলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশগুলোর ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলতে লাগল, না না, আমাদের বস্তির সেঙাইকে তোরা ফুঁড়েছিস। ওকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেব না, কিছুতেই না।