সাদা ধবধবে সাহেবটা বিজাতীয়, দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বিমূঢ়ের মতো বসওয়েলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সাঞ্চামখাবা।
আশ্চর্য! খাড়া টিলাটা বেয়ে কখন যে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি ওপরে উঠে এসেছে, কারো খেয়াল ছিল না। কণ্ঠার হাড়ের ফাঁকে লম্বা বাঁকা বর্শার ফলা গেঁথে গিয়েছিল। সেটাকে টেনে খুলে ফেলেছে সে। সাদা সারপ্লিসটা রক্তে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। মিশনারির প্রাণ, বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির জীবন, না না, অনেককাল আগের আবছা অতীতের নেপথ্যে ব্রেটনব্রুকশায়ারের এক ভয়ঙ্কর আউট লর প্রাণ বড় কঠিন। নাগা পাহাড়ের একটা বর্শার ফলা সেই প্রাণকে চিরকালের জন্য থামিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
সাঞ্চামখাবাকে সমানে উৎসাহ দিয়ে চলেছে বসওয়েল, ছোড় ছোড়, বেশ তাক করে বর্শাটা ছোড় দিকি। দেরি কোরো না।
পাশ থেকে ম্যাকেঞ্জি বলল, না না মিস্টার বসওয়েল, বর্শা ও ছুঁড়তে পারে না।
হোয়াই? ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে বসওয়েল বলল, আই সী, আপনি বেঁচে আছেন! আমি মনে করেছিলাম, মারা গেছেন।
ম্যাকেঞ্জি অদ্ভুত হাসল। সে হাসিতে ক্ষোভ জ্বালা আত্মপ্রসাদ আর দম্ভ সূক্ষ্মভাবে মিশে রয়েছে। স্থূল মানসিক বৃত্তির মানুষ বসওয়েল। তার পক্ষে ম্যাকেঞ্জির হাসির কারণগুলি বিশ্লেষণ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এমন চেষ্টাও সে করল না।
ম্যাকেঞ্জি বলতে লাগল, মিশনারির জীবন, বিশেষ করে আমার মতো মিশনারির প্রাণ এই নাগা পাহাড়ের একটা বর্শার ঘায়েই যদি শেষ হয়ে যায় তা হলে এখানে ব্রিটিশ রুল কদিন টিকবে বলতে পারেন মিস্টার বসওয়েল? একটু থেমে, যাক, যে কথা বলেছিলাম। স্পিয়ার ও ছুড়বে না।
কেন, কেন? হোয়াই? অনেকটা কাছাকাছি এগিয়ে এল বসওয়েল। তার মুখেচোখে ঔৎসুক্য ফুটে বেরিয়েছে।
ওদের প্রথা আছে, গর্ভিণী মেয়েদের গায়ে কেউ আঘাত করে না। তা সে যত শক্রই হোক। এই রীতি ওরা কিছুতেই অমান্য করবে না।
পাহাড়ী বিস্টগুলোর আবার নিয়ম টিয়ম আছে নাকি? স্ট্রেঞ্জ!
স্ট্রেঞ্জ বলে কিছু নেই মিস্টার বসওয়েল। পৃথিবীর সব জায়গাতেই নিয়ম রয়েছে। সব দেশের সব সমাজই তাদের নিজের নিজের প্রথা অনুযায়ী চলছে। এই নাগাদেরও নিজস্ব আইনকানুন, সামাজিক রীতিনীতি, আচার বিচার, শাসন শাস্তি থাকাই তো স্বাভাবিক।
আশ্চর্য! আমার ধারণা ছিল প্রিমিটিভ বর্বরদের সামাজিক বোধই নেই, সুশৃঙ্খল রীতিনীতি তো দূরের কথা।
মৃদু হেসে ম্যাকেঞ্জি বলল, এদের সামাজিক বোধ, আচার বিচার, আমাদের সভ্য মানুষদের চেয়ে অনেক সময় ভালো এবং শ্রেয় ছাড়া মন্দ নয়। সেসব কথা পরে হবে। বিকেল হয়ে আসছে। ঝপ করে রাত্রি নামবে। এখনই এই গ্রাম থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। রাত্রি হলে কোথায় কী ঘটে যাবে! জন্তু-জানোয়ার আছে। তা ছাড়া, বন্দুকের ভয়ে পাহাড়ীগুলো জঙ্গলে পালিয়েছে। অন্ধকারে হঠাৎ অ্যাটাক করে বসলে বেঘোরে মারা পড়তে হবে। সমস্ত গ্রাম তো জ্বালালাম, গুলি চালালাম, তছনছ করে খুঁজলাম কিন্তু গাইডিলিওকে পাওয়া গেল না। শয়তানীটা নিশ্চয়ই আমাদের গন্ধ পেয়েই পালিয়েছে। চলুন, ওই সালুয়ালা গ্রামেই ফিরে যাই। ওরা আমাদের নুন খেয়েছে। কখনই বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। ওদের কাছে নিরাপদে থাকা যাবে। কাল সকালে কোহিমা ফিরব।
ঠিক আছে।
সালুয়ালা গ্রামের বুড়ো সর্দার ছুটে এল ম্যাকেঞ্জির কাছে। আজ বিশেষ রকমের সাজসজ্জা করেছে সে। শত্রুপক্ষের গ্রাম কেলুরিতে অভিযান চালাবে। তাই আরি পী কাপড় পরেছিল। সেই কাপড়ে চিতাবাঘের মাথা, মানুষের কঙ্কাল, বুনো মোষের শিঙ এবং অজগরের মাথা আঁকা রয়েছে। মাথার মুকুটে হরিণের শিঙ ও ইবাতঙ পাখির পালক গুঁজেছিল। পায়ে বাঘের হাড় বাঁকিয়ে গোল করে পরেছে। কবজিতে হাতির চামড়ার পটি। দাঁতাল শুয়োরের অনেকগুলো দাঁত গলায় ঝুলিয়েছে, ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। মাথার তামাটে চুলগুলো সাপের চামড়ার ছিলা দিয়ে আঁটো করে বাঁধা। গা থেকে মিশ্র, উগ্র দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। এক থাবায় বিরাট সুচেন্যু, আর এক থাবায় লম্বা বর্শা। সর্দার বলল,হু-হু– ফাদার, হুই যে মেহেলীটা বসে রয়েছে। ওটার কোলে সেঙাই শয়তান শুয়ে আছে। তুই একবার বল, আমরা মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাই।
যাও, নিয়ে যাও তোমাদের মেহেলীকে। সালুয়ালাঙের সর্দারের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলল, কি সর্দার, খুশি তো?
হু-হু—
তোমরা তোমাদের মেহেলীকে পেলে। আমরা কিন্তু গাইডিলিওকে পেলুম না।
কী করব ফাদার, আমি তো ঠিক খবরই দিয়েছিলাম। ডাইনিটা যে এমন করে ভাগবে, কী করে জানব?
ঠিক আছে। এবার না হয় ভেগেছে। কতবার আর ভাগবে ডাইনিটা! তোমরা তাকে তাকে থাকবে। খবর পেলেই কোহিমায় চলে যাবে। গাইডিলিও ডাইনিটাকে ধরতেই হবে।
হু-হু, গাইডিলিও ডাইনির খবর পেলেই তোকে বলে আসব কোহিমায়। তোর নিমক খেয়েছি, টাকা কাপড় নিয়েছি। নিমকহারামি করব না।
মনে থাকে যেন। মেহেলীকে নিয়ে তোমাদের গ্রামে চল। ম্যাকেঞ্জির গলাটা বড়ই উদার শোনাল। নির্বিকার ভঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে বসল সে।
আর সাঁ করে ঘরে দাঁড়াল সালুয়ালা গ্রামের সর্দার। তার কুতকুতে ঘোলাটে চোখজোড়া নানাকোয়া ও সালুয়ালা গ্রামের জোয়ান ছেলেদের মুখের ওপর দিয়ে সরে সরে যেতে লাগল। ধারাল সুচেনুটা নামিয়ে রেখে ডান হাত দিয়ে বুকের ওপর গোটা কয়েক চাপড় বসিয়ে দিল সে। তারপর চিৎকার করে উঠল, যা জোয়ানের বাচ্চারা, হুই মেহেলী মাগীকে ছিনিয়ে আমাদের বস্তিতে নিয়ে যা।