এই পাহাড়ী পৃথিবীর ক্রোধ বড় ভয়ঙ্কর এবং সর্বনাশা। তার প্রকাশও আকস্মিক। কখন কোন কথায়, কোন ঘটনায় এই বন্য আদিম মানুষগুলো জ্বলে উঠবে, আগে থেকে তার হদিস মেলে না। কিন্তু অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এখন খেপে উঠল সাঞ্চামখাবা। দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগল, সোয়ামী! শব্দুরদের হুই সেঙাই শয়তানটা তোর সোয়ামী হবে! আপোটিয়া। হোক আনিজার গোসা, আজ তোকে আর হুই সেঙাইটাকে এখানেই খতম করে বস্তিতে ফিরব। খারে বর্শাটা মাথায় ওপর তুলে লক্ষ্য ঠিক করতে লাগল সাঞ্চামখাবা।
হা-আ-আ-আ–বর্শাটা ছুঁড়ে মারার ঠিক আগেই চেঁচাতে চেঁচাতে জোরি বংশের বাড়ি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ল জামাতসু। ছুটতে ছুটতে মেহেলীকে আড়াল করে দু হাত তুলে একটানা চিৎকার করতে লাগল।
সাঞ্চামখাবার হাতে বর্শাটা কেঁপে গেল।
উত্তেজনায়, আশঙ্কায় এবং লাফিয়ে এতটা পথ ছুটে আসার ধকলে সমস্ত দেহ থরথর কাঁপছে সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর। জামাতসু গর্ভিণী। কয়েকদিনের মধ্যেই এই পাহাড়ে একটা বাচ্চার জন্ম দেবে। স্ফীত উদর, ভারী পাছা। স্তন দুটো টসটস করছে। তার আলস্যভরা চোখ থেকে এখন আগুনের হলকা ছুটছে। নিজের রক্তমাংস দিয়ে মাতৃকুক্ষিতে একটি প্রাণ। সযত্নে লালন করছে, এই পাহাড়কে একটা তাজা সজীব জীবন উপহার দেবে, সেই গৌরবে এবং দেমাকে গর্ভ হবার পর থেকেই সমস্ত গ্রামটায় কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সে হেঁটে বেড়াত। এখনকার জামাতসুর সঙ্গে সেই গর্ভধারণের গর্বে ভরপুর জামাতসুর কত তফাত!
জামাতসু হুমকে উঠল, শয়তানের বাচ্চারা, মেহেলীকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিস! সালুয়ালাঙ বস্তির সেরা মেয়েটার সঙ্গে এই কেলুরি বস্তির সেরা মরদটার বিয়ে হবে। তোদের তা সইছে না কেন রে রামখোরা? যা যা, হুই পাহাড়ের মাথা থেকে খাদে লাফিয়ে মর গিয়ে। টেটসে আনিজা তোদের ঘাড় মুচড়ে রক্ত খাক। নিজেরা লড়াই করে মেহেলীকে কেড়ে নিতে পারিস না, সঙ্গে করে আবার সায়েবদের এনেছিস! মুরোদ কত! প্রচণ্ড রাগে জামাতসু ফঁসে ফুঁসে উঠতে লাগল।
জোহেরি বংশের বাড়ি পুড়ছে। বাঁশের গাঁটগুলো শব্দ করে ফাটছে। টিলার মাথায় দাপাদাপি করতে করতে বসওয়েল অট্টহাসি হাসছে, হাঃ হাঃ হাঃ–হোয়ের ইজ গাইডিলিও? এই পাহাড়ের মাথায় মাথায় আমি আগুন লাগিয়ে দেব। দেখি কত দিন, ইয়াস, হাউ লঙ দ্যাট মিংক্স গাইডিলিওটা লুকিয়ে থাকতে পারে! হাঃ-হাঃ-হাঃ–
বিকট গলায় হাসতে হাসতে বসওয়েল মাথা ঘুরিয়ে এদিকে তাকাল। কিছুটা কৌতুকে এবং অভাবনীয় উল্লাসে তার চোখজোড়া জ্বলে উঠল। হাঁ করা মুখ থেকে বিস্ময়ের একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল, এঃ–
তারপরেই বসওয়েল চেঁচিয়ে উঠল, এহ, হোয়াট আ ফান! পাহাড়ীটা বর্শা দিয়ে তাক করছে। সামনে মাগীটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। লিভিং টার্গেট! হাউ ইন্টারেস্টিং! হোয়াট আ ফান!
জোহেরি কেসুঙের পাশ থেকে এলোপাথাড়ি পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বসওয়েল ছুটে এল। এই নাগা পাহাড়ে, এই বুনো প্যাগানদের দেশে তার জন্য এমন একটা বিস্ময়কর, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল, আগে কি কখনও তা কল্পনা করতে পেরেছিল সে? একটা পাহাড়ী মানুষ বর্শা দিয়ে চোখের সামনে জীবন্ত একটি মেয়েকে খুঁড়বে। কী মজা!
সেঙাইর মাথাটা উরুর ওপর রেখে দুহাত দিয়ে চেপে বিহ্বল হয়ে বসে রয়েছে মেহেলী। খানিক আগে জামাতসুই বুড়ো খাপেগাকে বলেছিল, মেহেলী আর সেঙাই বিয়ের আগে পরস্পরকে দেখেছে। পাহাড়ী প্রথা অনুযায়ী বিয়ের আগে ভাবী বর-বউর দেখাসাক্ষাৎ এবং কথা বলার কারণে যে অপরাধ হয়েছে তার ক্ষমা নেই। সেই মারাত্মক পাপাঁচরণের কথা জানাবার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন কর্তব্যও বুড়ো খাপেগাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল জামাতসু। মেহেলীকে শাস্তি দিতে হবে। ভীষণ, নিষ্ঠুর শাস্তি।
তাজ্জবের ব্যাপার, সেই গর্ভিণী জামাতসুই এখন সাঞ্চামখাবার উদ্যত বর্শার সামনে মেহেলীর নিশ্চিত মৃত্যুকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। হতভম্ব হয়ে বসে থাকা ছাড়া মেহেলী কী-ই বা করতে পারে?
সাঞ্চামখাবা গর্জে উঠল, এই মাগী, ভাগ এখান থেকে।
আমি কেন ভাগব? তুই ভাগ শয়তানের বাচ্চা। আমাদের বস্তি থেকে তোরা সবাই ভাগ।
গর্ভবতী নারীকে আঘাত করা এই পাহাড়ের নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এমন অপকর্ম কেউ করে বসলে তার শাস্তি হল মৃত্যু।
বর্শাটা মাথার ওপর থেকে নামিয়ে খ্যাপা বাঘের মতো ফুঁসতে লাগল সাঞ্চামখাবা। এই মাগী, বর্শার সামনে থেকে সরে বাচ্চা বিয়োতে যা।
কিছুতেই যাব না রে ধাড়ি টেফঙ। আমি জ্যান্ত থাকতে মেহেলীকে খুঁড়তে দেব না। তেলাঙ্গা সু মাসে মেহেলী সেঙাই-এর বউ হবে। তাকে কিনা ফুঁড়তে এসেছিস শয়তান! ইজা হুবুতা। জামাতসু খেঁকিয়ে উঠল।
নিরুপায় আক্রোশে সাঞ্চামখাবা চেঁচাতে লাগল, মেহেলী হবে মেজিচিজুঙের বউ। মেজিচিজুঙের বাপ রাঙসুঙের কাছ থেকে আমি বউপণ নিয়েছি। একটু দম নিয়ে আবার ফোসানি শুরু হল, আর মেহেলীর সঙ্গে বিয়ে হবে কিনা সেঙাই-এর! সরে যা মাগী। নইলে–
ভয়ানক ইঙ্গিত দিয়ে সাঞ্চামখাবা থেমে গেল।
লাফাতে লাফাতে সাঞ্চামখাবার পাশে এসে দাঁড়াল বসওয়েল। একসঙ্গে হাত-পা-মাথা নেড়ে প্রচুর উৎসাহ দিতে লাগল সাঞ্চামখাবাকে, ইয়াস, জাস্ট থ্রো দা স্পিয়ার। অ্যামুজিঙ ইমপালসিভ গেম, আই সী। থ্রো–