প্রথমত, যুগলের সঙ্গে গত বেস্পতিবার যখন তার দেখা হয়, তখনও অবনীমোহন কলকাতায় ফিরে আসেননি। তার সঙ্গে কথা না বলে সে ঝিনুককে নিয়ে মুকুন্দপুরে যায়ই বা কী করে? আর যুগল বলল বলেই হুট করে ওখানে গিয়ে থাকতে শুরু করল, তা কি আদৌ সম্ভব? সুধা তাদের ছাড়ত না, হিরণ ছাড়ত না। সুনীতি আর আনন্দ মুখ ফুটে হয়তো কিছু বলত না। কিন্তু কষ্ট কি কম পেত? তাছাড়া মুকুন্দপুরে উঠতই বা কোথায়? কলোনির লাগোয়া বিশাল জঙ্গল নির্মূল করে জমি বার করা হবে, সেখান থেকে তাকে সাত কাঠা জায়গা দেওয়া হবে। মোটামুটি এটাই ওখানকার বাসিন্দাদের একান্ত ইচ্ছা। কিন্তু জমি পেলেই তো হয় না, সেই জমিতে ঘরবাড়ি তুলতে হবে, তবেই মুকুন্দপুরে যাওয়া। অবশ্য তারা গেলে যুগলরা তো বটেই, কলোনির অনেকেই তাদের ঘর ছেড়ে দিত। শুধু তাই না, মাথায় করেও রাখত। কিন্তু ওভাবে তো থাকা যায় না।
পরক্ষণে বিনু নিজেকে জোরে ধমক কষায়। মুকুন্দপুরের মানুষজন সবাই যুগলের মতো সোজাসাপটা সাদাসিধে হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। প্যাগোয়া লোকও কি দুচারটে ওখানে নেই? মুখ ফুটে হয়তো তারা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করত না, কিন্তু তাদের অনেকের মাথায় এই প্রশ্নটা অবিরত পাক খেত, বিনুর সঙ্গে ঝিনুকের সম্পর্কটা কী? বিয়ে হয়নি তবু তাকে নিয়ে হাজির হয়েছে, এটা খুবই দৃষ্টিকটু।
তাছাড়া, কলকাতায় বিনয়ের চাকরি ঠিক হয়ে আছে। খবরের কাগজের নিয়মকানুন কিছুই তার জানা নেই। কতক্ষণ তাকে অফিসে থাকতে হবে, কী করতে হবে, কখন ছুটি পাওয়া যাবে, কে জানে। অতদূর থেকে রোজ তিন সাড়ে তিন মাইল হেঁটে আগরপাড়া স্টেশনে এসে শিয়ালদা, সেখান থেকে বাসে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। কাজ সেরে একই রুটে আবার মুকুন্দপুরে ফেরা। না না, রোজ এত সব তার পক্ষে অসম্ভব।
হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, কী হাবিজাবি ভাবছে সে। যাকে নিয়ে মনের ভেতর এমন আলোড়ন, সেই ঝিনুকই তো নিরুদ্দেশ। এ ধরনের অনর্থক চিন্তায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না।
দুই হাঁটুর ফাঁকে থুতনি রেখে কী ভাবছিল যুগল। হঠাৎ তড়িৎগতিতে মুখ তুলে ডাকল, ছুটোবাবু।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে, কিছু বলবে?
আমার কী মনে লয় জানেন?
কী?
ঝিনুক বইনে হেই দিন মনের কষ্টে কুনখানে যাইতে পারে, মেলা (অনেক) ভাইবা দেখলাম।
অবাক বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে?
যুগল বলে, আমার মনে লয়, দুইহানে হের (তার) যাওনের জাগা আছে। পেরথমটা হইল পাকিস্থান
বিনয় এবং সুধা হতভম্ব। একসঙ্গে তারা বলে ওঠে, পাকিস্তান! কী বলছ তুমি! যেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বিনয় তাকে বর্ডারের এপারে নিয়ে এসেছে, ঝিনুক সেই হননপুরীতে ফিরে যাবে, এ ভাবাই যায় না। সেখানে তার ভরসা বলতে হেমনাথ, স্নেহলতা আর শিবানী। এই মুহূর্তে হেমনাথরা কোন সংকটের মধ্যে রয়েছেন, কে জানে। তার চেয়েও বড় সমস্যা ঝিনুক একা একা ট্রেনে, স্টিমারে এবং নৌকোয় করে রাজদিয়ায় ফিরে যেতে পারবে তা কল্পনা করতেও সাহস হয় না। এই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি নাকচ করে দিল বিনয়। কলকাতায় যতই অসম্মান আর গ্লানিবোধে ঝিনুকের সমস্ত অস্তিত্ব খান খান হয়ে যাক, পাকিস্তানে তার ফিরে যাবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
যুগল বলল, তাইলে আর-একহানে যাইতে পারে—
বিনয় জিজ্ঞেস করে, কোথায়?
শিয়ালদার ইস্টিশানে। হেইহানে রিফুজিগো লগে বুঝিন মিশ্যা রইছে।
হাতে একটা পয়সা নেই। তার ওপর এই শহরের কতটুকুই বা দেখেছে ঝিনুক! সেদিন সন্ধ্যায় হিমঋতুর কুয়াশা যখন অবিরল ঝরে চলেছে তখন সে কি হেঁটে হেঁটে যেতে পেরেছে শিয়ালদা পর্যন্ত এতটা পথ? পরক্ষণে ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা বিনয়ের মাথায় চকিতে হানা দিয়ে যায়। গেলে একমাত্র সেখানেই যেতে পারে ঝিনুক। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে। শিয়ালদা স্টেশন, সেখানকার অতগুলো প্ল্যাটফর্ম, বাইরে বিশাল খোলা চত্বর জুড়ে শুধুই উদ্বাস্তু। হাজার হাজার মানুষের থিকথিকে ভিড়ে আশ্রয় পেতেই পারে সে, আদৌ যদি শিয়ালদায় পৌঁছে থাকে।
যুগল বলল, লন (চলুন) যাই ছুটোবাবু, শিয়ালদা ইস্টিশানখান একবার বিচরাইয়া দেহি। ভগমান মুখ তুইলা চাইলে, ঝিনুক বইনেরে হেইখানে পাইয়াও যাইতে পারি– ।
সাঁতার না-জানা মানুষ মহাসমুদ্রে পড়লে হাতের কাছে একটা কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। সুধা বলল, যা না বিনু, যুগলের সঙ্গে শিয়ালদায় গিয়ে একবার দ্যাখ। কে বলতে পারে, ঝিনুক হয়তো সেখানেই চলে গেছে
গুছিয়ে ভাবার মতো শক্তি বা সাহস কোনওটাই অবশিষ্ট নেই বিনয়ের। শিয়ালদায় গেলেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, এমন আশা শতভাগের একভাগও আছে কি না সন্দেহ। তবু কেউ যেন ভেতর থেকে তাড়া দিয়ে বিনয়কে টেনে তুলল। নাও যদি পাওয়া যায়, যুগল যখন চিন্তাটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে, একটা চেষ্টা অন্তত করা যাক।
জামাকাপড় পালটে যুগলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে বিনয়। ওদের সঙ্গে সুধাও বেরুল। সে বাড়ি ফিরে যাবে। রাস্তা পেরিয়ে ওধারে গিয়ে বাসে উঠল বিনয়রা। টালিগঞ্জের ট্রামের জন্য এপাশে দাঁড়িয়ে রইল সুধা।
.
০৩.
ধর্মতলায় এসে বাস বদলে বিনয় আর যুগল যখন শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছল, শীতের বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দূরে হ্যারিসন রোড আর সার্কুলার রোডের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় যে মলিন, নিবু নিবু রোদটুকু লেগে আছে তার আয়ু আর কতক্ষণ? চোখের পলক পড়তে না পড়তেই মুছে যাবে।