কনকনে হাওয়া যে গায়ে ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে, খেয়াল নেই বিনয়ের। তার শরীর থেকে শীতবোধটাই কেউ বুঝি বা হরণ করে নিয়েছে।
অবনীমোহন বাড়িতে নেই। কী একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছেন সন্ধের পর ফিরবেন। খগেন একতলায় কী করছে, কে জানে। লোকটা হাত-পা গুটিয়ে এক লহমা চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। সর্বক্ষণ এটা করছে সেটা করছে।
কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে, নিজেই টের পায়নি বিনয়।
আচমকা চেনা একটা গলা কানে ভেসে আসতে শিরায়ুতে চমক খেলে যায়। ছুটোবাবু ছুটোবাবু –সেই সঙ্গে সিঁড়ি ভাঙার ধুপধাপ আওয়াজ।
খানিক পরে দেখা যায় দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে যুগল, সুধা এবং সবার পেছনে খগেন।
চকিতে হাতের পিঠে চোখের জল মুছে ধড়মড় করে উঠে বসে বিনয়। যুগলকে এ-বাড়িতে এসময় দেখতে পাবে, ভাবতে পারেনি। আসলে ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর যুগলের কথা ক্ষণকালের জন্যও তার মাথায় আসেনি। সারা পৃথিবী তার কাছে পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
বিনয় বলল, আয় ছোটদি, এস যুগল, ভেতরে এসে বোসো- খগেন যে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। তাকে বলল, তুমি তোমার কাজ কর গিয়ে
খগেন নীরবে চলে গেল।
যুগল আর সুধা ঘরে এসে ঢোকে। সুধা বিনয়ের খাটের একধারে বসে পড়ে। যুগল মেঝেতে থেবড়ে বসে। বিনয় লক্ষ করল, যুগলের পায়ের ব্যান্ডেজ অনেক ছোট হয়ে গেছে। চলাফেরায় বা উঠতে বসতে আগের সেই কষ্টটা আর নেই। মারাত্মক চোটটা প্রায় সেরে এসেছে।
বিনয় হাঁ হাঁ করে ওঠে, ও কী, ওই ঠাণ্ডা মেঝেতে বসলে কেন? ওই কোণে বেতের মোড়া আছে। একটা টেনে এনে বোসো।
যুগল তার কথায় আমল দেয় না। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল, এইটা কী অ্যামন টালকি (ঠাণ্ডা)? আমাগো মুকুন্দপুরে গিয়া দ্যাহেন, শীতে শরীল এক্কেরে কালাইয়া যাইব। হেইতেই আমার কিছু হয় না। কইলকাতার এই টালকিতে কী আর হইব? আমার লেইগা ভাইবেন না ছুটোবাবু
যুগল যে তার সামনে উঁচু জায়গায় অর্থাৎ চেয়ার বা মোড়ায় বসতে চায় না তা আগেই জেনে গেছে বিনয়। যাদের বাড়িতে কামলা খেটেছে তাদের সঙ্গে একই উচ্চতায় তাকে বসানো মুশকিল। অন্য সময় হলে জোরজার করত কিন্তু এই মুহূর্তে এ-সব নিয়ে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
যুগল পলকহীন বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখটা ক্রমশ মলিন হয়ে যেতে থাকে। বিষঃ এবং করুণ। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, বিষুদবার বিষুদবার হাসপাতালে ঘাও (ঘ) ধুয়াইয়া, পট্টি পালটাইয়া ছুটোদিদির বাড়িত যাই। আইজ আইয়া যা শুনলাম, বুক এক্কেরে ভাইঙ্গা গ্যাছে ছুটোবাবু। এয়া (এ) আমি চিন্তাও করতে পারি নাই। তার কণ্ঠমণিটা সমানে ওঠানামা করছে। গলা ধীরে ধীরে বুজে এল।
বিনয়ের মনে পড়ে গেল, ফি বেস্পতিবার হাসপাতাল থেকে সুধাদের বাড়ি আসে যুগল। সে কী ইঙ্গিত দিয়েছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। যুগলের কষ্টটা তার নিজের যন্ত্রণাকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিনয় কিছু বলতে যাচ্ছিল, পারল না। গলার কাছে শক্ত, নিরেট পাথরের মতো কী যেন ডেলা পাকিয়ে গেল।
সুধা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলল, হাসপাতাল থেকে আমাদের কাছে এসেই যুগল তোদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ঝিনুক চলে গেছে শুনে পাগলের মতো হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তক্ষুনি তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য এখানে চলে আসতে চাইছিল। সেই কতদূর মুকুন্দপুর থেকে কোন ভোরবেলায় বেরিয়েছে। খাওয়াদাওয়া হয়নি। অনেক কষ্টে ওকে আটকে রেখে দুটি ভাত খাওয়ালাম। তারপর আর ধরে রাখা গেল না। আমিও ওর সঙ্গে চলে এলাম। একটু থেমে বলল, খগেনের কাছে শুনলাম বাবা নাকি বেরিয়েছে।
আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়, হ্যাঁ।
প্রশ্নটা অর্থহীন, তবু সুধা জিজ্ঞেস করে, ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া গেল না?
বিনয় চুপ করে থাকে। তার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেই উত্তরটা রয়েছে।
বিমর্ষতা খানিক কাটিয়ে উঠেছিল যুগল। ঝাঝালো গলায় এবার বলে, পুলিশের অত জবর জবর কর্তারা রইছে। গরমেন তাগো মেলা মেলা (অনেক অনেক) ট্যাকা দিয়া পুষতে আছে। এট্টা বষ্যের মাইয়া (যুবতী) সন্ধ্যাবেলা শয়ে শয়ে মাইষের চৌখের সুখে (সামনে) হারাইয়া গ্যাল। হেরে (তাকে) অ্যাত দিনেও বিচরাইয়া (খুঁজে) বাইর করতে পারল না? পুলিশের পিছনে ট্যাকা খরচা করনের কুন কাম? পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, রাগ এবং বিরক্তি উগরে দিতে লাগল সে।
বিনয় কী জবাব দেবে? সে তো রোজই দুবার করে থানায় হাজিরা দেয়। দিবাকর পালিতদের আন্তরিকতা বা চেষ্টার কোনও খামতি নেই। থানায় যাওয়া ছাড়া বিনয় নিজেও রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে, কতদিন ধরে কম ঘুরছে? কিন্তু ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে কই?
আক্ষেপের সুরে যুগল এবার বলল, ঝিনুক বইনেরে আমাগো মুকুন্দপুরে যদিন লইয়া যাইতেন, এই সব্বনাশটা হইত না। আমরা বইনেরে বুকে কইরা রাখতাম।
আবেগের ঝেকে কথাগুলো বলল যুগল। কিন্তু সবে ঝিনুককে নিয়ে কলকাতায় এসেছে বিনয়। এখনকার আত্মীয়পরিজন ছেড়ে বহু দূরে এক বিজন এলাকার জবরদখল কলোনিতে তাকে নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব ছিল? যুগল যদিও ভরসা দিয়েছিল, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত তরুণী অনেকেই আছে মুকুন্দপুরে। সেখানে ঝিনুকের অসম্মান বা গ্লানির কোনও কারণই নেই, তবু সংকটের অবসান এত সহজ নয়।