এখন এসব আলোচনা করে কী হবে ছোটদি? সবচেয়ে আগে যা দরকার তা হল ঝিনুককে খুঁজে বার করা।
একটা কথা তোকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছি—
কী?
সুধা জেদি গলায় বলেছে, ঝিনুককে পাওয়া গেলে আমার কাছে নিয়ে যাব। সে ওখানেই থাকবে।
এসব সুধার আক্ষেপের কথা মনঃকষ্টের কথা আবেগের কথা মানসিক যাতনার কথা। অবনীমোহনের ওপর সে যে ভয়ানক ক্ষুব্ধ, সুধার মতো একটি চিরদুঃখী মেয়ের প্রতি তার নির্দয় আচরণ সে যে আদৌ মেনে নিতে পারেনি, অশেষ ক্লেশে তার বুক যে ভেঙেচুরে গেছে, সেটা বুঝতে পেরেছিল বিনয়। অসহ্য ক্রোধে, অভিমানে সুধার মাথা থেকে যাবতীয় যুক্তিতর্ক লোপ পেয়ে গিয়েছিল। ঝিনুককে যদি সত্যিই পাওয়া যায় আর সুধা তাকে টালিগঞ্জে নিজের কাছে নিয়ে তোলে, পাটনা থেকে ফিরে ওর দাদাশ্বশুররা এসে তাকে দেখলে কত সহস্র সমস্যার সৃষ্টি হবে, সেসব ভাবেনি সুধা। রাগে, অসন্তোষে, মস্তিষ্কের অসহ্য উত্তাপে তখন সে টগবগ ফুটছে। তাকে বোঝাতে যাওয়া মুশকিল। অগত্যা বিনয় চুপ করে থেকেছে।
সুধা কিন্তু অত সহজে ছাড়েনি, কী, ঝিনুক আমার কাছে থাকবে তো?
বললাম তো, ও আগে ফিরে আসুক। তারপর দেখা যাবে।
.
আরও কটা দিন পার হয়ে গেল।
থানায় বা রাস্তায় রাস্তায় উন্মাদের মতো বিনয়ের ছোটাছুটিই সার। মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে কোথায় যে ঝিনুক মিলিয়ে গেছে তার কোনও হদিসই পাওয়া গেল না। কখনও পাওয়া যাবে কি না, কে জানে।
একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে বিনয়। ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর সবার আক্ষেপ এবং ক্লেশের তীব্রতা ক্রমশ কমে আসছে। শোক, দুঃখ বা মানসিক যাতনা তো চিরদিন উঁচু তারে বাঁধা থাকে না। পার্থিব নিয়মেই শিথিল হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা সয়েও আসে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অসহনীয় বলে বুঝি বা কিছু নেই। কিন্তু বিনয়ের কষ্টটা যত দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে। জীবনের কতখানি অংশ যে ঝিনুক ফাঁকা করে দিয়ে গেছে, প্রতিটি মুহূর্তে সে টের পাচ্ছে। আর দুঃখের সীমা-পরিসীমা নেই সুধার। বিনুর সঙ্গে দেখা হলে তার একটাই কথা কেন মেয়েটাকে ভবানীপুরে আসতে দিয়েছিলাম! কেন তাকে জোর করে নিজের কাছে ধরে রাখিনি!
কদিনে সবচেয়ে আশ্চর্য রকমের বদলে গেছেন অবনীমোহন। গোড়ার দিকের সেই মনস্তাপ প্রায় নেই বললেই চলে। ইদানীং তিনি বলছেন, কারও কিছু করার নেই। ঈশ্বরের খুব সম্ভব এটাই ইচ্ছা ছিল। তার নির্দেশ ছাড়া কিছুই হবার নয়। এমনকি একটা ঘাসের ডগাও নড়ানো যায় না। যা ঘটে গেছে ঈশ্বরের বিধান হিসেবে তা মেনে নিতে হবে।
ধর্মকর্ম করলে মানুষ কি চরম নিরাসক্ত হয়ে যায়? কিংবা নিষ্ঠুর? অবনীমোহনের সান্ত্বনা বাক্যগুলি ফাঁকা ফাঁকা, অসার মনে হয়। ঝিনুকের নিরুদ্দেশ হবার মতো এত বড় একটা ঘটনাকে ঈশ্বরের ইচ্ছায় চাপিয়ে দিয়ে যিনি দায়মুক্ত হতে চান তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ভয় হয় বিনয়ের। এই নির্মোহ, মমতাহীন অবনীমোহন তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা, অন্য কোনও অপরিচিত গ্রহের মানুষ।
বাবাকে দেখতে দেখতে চমকে ওঠে বিনয়। মনে পড়ে সেদিন ঝুমাকে সেও বলেছিল, ঝিনুক যে নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটা তার ভাগ্যলিপি। অবনীমোহন ঈশ্বরের ঘাড়ে দায়টা চাপিয়েছেন আর সে চাপিয়েছে ভাগ্যের ওপর। দোহাইটা প্রায় একইরকম। কিন্তু ভাগ্যকে টানাটানি করার লেশমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। কেন যে মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল তার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ঝিনুকের নিখোঁজ হবার আসল হেতুটা কী তা সে জানে না? খুব জানে। এ নিয়ে যত ভাবে, নিজের কাছে ততই ছোট হয়ে যায়।
অবনীমোহন আজকাল প্রায়ই বলেন, ঝিনুকের চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তোমার সামনে অফুরন্ত ভবিষ্যৎ। তুমি তার কথা ভাবো।
বাবার কথায় উত্তর দেয় না বিনয়। তার সব উৎসাহ, বেঁচে থাকার আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। সমস্ত উদ্দীপনা ম্রিয়মাণ।
.
আজ বৃহস্পতিবার।
অঘ্রান মাস পড়ে গেছে। বেশ কিছুদিন হল উত্তুরে হাওয়ায় টান ধরেছিল। এমনিতে কলকাতায় ঠাণ্ডাটা একটু দেরিতেই হানা দেয়। কিন্তু এ-বছর অনেক আগেই এসে পড়ল।
অবনীমোহন তেতলায় তার ঘরের পাশের ঘরটায় বিনয়কে থাকতে বলেছিলেন। অর্থাৎ যে কদিন বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা না হচ্ছে, এখানেই সে থাকুক। বিনয় তেতলাটা পছন্দ করেনি। দোতলার কোণের একটা ঘর বেছে নিয়েছে।
অন্যদিনের মতো আজও সকালের দিকে থানায় গিয়েছিল বিনয়। তারপর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঝিনুকের খোঁজে ঘোরাঘুরি করে যথারীতি ক্লান্ত এবং নিরাশ হয়ে দুপুরের খানিক আগে ফিরে এসেছে। চান করতে হয় তাই চান করেছে, খেতে হয় তাই খেয়েছে। মুখ এতই বিস্বাদ, জিভ আগাগোড়া এমনই কটু এবং তিক্ততায় ভরা যে ভাত ডাল তরকারি কী খেয়েছে, কিছুই ভাল করে বুঝতে পারছিল না।
খাওয়ার পর নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল বিনয়। শিয়রের দিকের জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছে হুহু করে। কলকাতার তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ঝপাঝপ। অতি দ্রুত।
বেলা অনেকটা হেলে গেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে দূরের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর আড়ালে। অঘ্রানের ক্ষীণায়ু দিন ঝটিতি ফুরিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ত্বরিত পায়ে নেমে আসবে সন্ধে। তারই তোড়জোড় চলছে।