আনন্দ সুনীতি ঝুমা–সবাই ভীষণ চিন্তিত, বিমর্ষ। আনন্দ বিষণ্ণ সুরে বলেছে, কোথায় যে গেল মেয়েটা, কিছুই বুঝতে পারছি না।
সুনীতি অবনীমোহনকে বলেছে, বাবা, তোমার ওভাবে ঝিনুককে বলা ঠিক হয়নি।
ঝিনুক হারিয়ে যাবার পর অবনীমোহন প্রতিটি মুহূর্ত অনুশোচনায় বিদ্ধ হচ্ছিলেন। জবাবদিহির সুরে বলেছেন, আমি কিন্তু ঝিনুককে কিছুই বলিনি। বিনুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলব বলে ওকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেছিলাম। চলেও গিয়েছিল। কিন্তু বাইরে গিয়ে মেয়েটা যে শুনে ফেলবে, ভাবতেই পারিনি।
এদিকে পলকহীন আনন্দর দিকে তাকিয়ে থেকেছে বিনয়।
বিনয়ের মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে আসছিল, আমার বাবাই শুধু নয়, তোমার মাও কতখানি হৃদয়হীন ব্যবহার ঝিনুকের সঙ্গে করেছে সেটা ভেবে দেখ– কথাগুলো অবশ্য বলা হয়নি।
ঝুমা কিন্তু বিনয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে হেমনলিনী সম্পর্কে বলেছে, আমার দিদা এখন ভালমানুষ মাজছে। সারাক্ষণ তার মুখে ঝিনুকের জন্য আহ, উন্থ। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। দিদার ন্যাকামো দেখে গা জ্বলে যায়। ঝিনুক যখন ও-বাড়িতে ছিল, কী অসভ্যতা করেছে, আমি জানি না?
একটা মানুষের নিরুদ্দেশ হবার সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের যে কত রকম প্রতিক্রিয়া! বিনয় উত্তর দেয়নি।
ঝুমা তীব্র, কটু গলায় এবার বলেছে, কীরকম কায়দা করে দিদা ও-বাড়ি থেকে মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিল! ইতর! অমানুষ! সে থামেনি, দিদা যদি ঝিনুককে তাদের কাছে থাকতে দিত, এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটত না।
বিনয় বলেছে, তুমি যা ভাবছ তা হয়তো ঠিক নয়, ঝুমা।
বুঝতে না পেরে ঝুমা জিজ্ঞেস করেছে, কী ঠিক নয়?
ধর তোমার দিদিমা হয়তো ভাল ব্যবহার করতেন। কিন্তু তাঁর কাছে চিরকাল তো থাকা যেত না। একদিন না একদিন বাবার কাছে চলে আসতে হতো। ছোটদিদের কাছে সপ্তাহ দুই থেকে চলেও এসেছিলাম। কিন্তু বাবাও একই কাণ্ড করলেন। একা মাউইমাকে দোষ দিয়ে কী হবে? সবই ওর ভাগ্য।
ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিও না বিনুদা। দু-দুটো বয়স্ক মানুষ ওর ওপর এমন জঘন্য অন্যায় করল, আর তুমি ভাগ্যের ওপর ওদের অপরাধ চাপিয়ে দিচ্ছ! তোমার কাছে এটা আশা করিনি। একটু থেমে ধরা ধরা গলায় বলেছে, ঝিনুকের জন্যে কী কষ্ট যে হচ্ছে বিনুদা– তার দুচোখ ক্রমশ বাষ্পে ভরে যাচ্ছিল।
হতবাক তাকিয়েই থেকেছে বিনয়। এই কি সেই ঝুমা যে চটুল, প্রগম্ভ, সারাক্ষণ যার কলকলানি। সেই কোন কৈশোর থেকে তার মাথায় অবিরল প্রেম প্রেম খেলা চলে আসছে। অদৃশ্য পোকার মতো যেটা সমানে কুটুর কুটুর কামড়ায়। বিনয়কে রাজদিয়ায় প্রথম দেখার পর থেকেই সেই কামড়টা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পাকা মেয়েটা মাত্র বারো বছর বয়সে একটি চুম্বনে তার রক্তমাংসে শুধু শিহরনই জাগায়নি, তাকে এক লহমায় যৌবনের অনন্ত রহস্যের ভেতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে। ঘিরে ঝিনুকের সঙ্গে কী তীব্র প্রতিযোগিতা, কী নিদারুণ মহাযুদ্ধ! তাকে দখল করার জন্য কতরকম ফন্দিই না বার করত ঝুমা। কিন্তু ঝিনুকের চোখে ধুলো ছিটানো অত সহজ নয়। ফি বারই কুমার যাবতীয় কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে সে। কলকাতায় এসেও কি সেই অঘোষিত যুদ্ধ থেমেছে? ঝিনুক লাঞ্ছিত হয়েছে, তার শরীর ও মন ভেঙেচুরে তছনছ, মাথার ওপর সৌরলোক শতখান হয়ে ভেঙে পড়েছে কিন্তু লহমার জন্যও বিনয়ের স্বত্ব ছাড়তে সে রাজি হয়নি। এদিকে ঝুমাও পণ করেছিল, বিনয়কে সহজে ছেড়ে দেবে না।
অথচ সেই ঝুমারই দুচোখ ঝিনুকের জন্য জলে ভরে গেছে। এই ঝুমা বিনয়ের অচেনা। যাকে সে এতকাল দেখে এসেছে, যার স্বভাবের অন্ধিসন্ধি তার জানা, সে যেন অন্য কেউ। ঝুমার ভেতর থেকে এমন বিস্ময়কর এক তরুণী বেরিয়ে এসেছে যার কথা আগে কখনও ভাবেনি বিনয়। একই মানুষের ভেতর কত ধরনের মানুষ যে লুকনো থাকে! ঝিনুকের জন্য ঝুমার কষ্ট যে কতখানি আন্তরিক তা বুঝিয়ে দিতে হয় না।
ঝুমা আকুলভাবে বলেছে, বিশ্বাস কর বিনুদা, এটা আমি চাইনি। যেমন করে পার ওকে খুঁজে বার কর। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করেছে, রাস্তায় বেরুলে আমাদের বয়সী মেয়ে দেখলেই তার দিকে ভাল করে তাকাই, যদি ঝিনুককে পেয়ে যাই। কিন্তু না, আজও তার দেখা পাইনি তার গলা বিষাদে ভরে গেছে।
সুধা আর হিরণ কাছাকাছি থাকে। তারা রোজই এসেছে।
সুধা জানিয়েছে, তার দাদাশ্বশুর এবং জেঠশাশুড়ি এক্ষুনি পাটনা থেকে ফিরছেন না। আরও মাসখানেক মাসদেড়েক ওখানে থাকবেন। কাচুমাচু মুখে বলেছে, বাবার কাছে তোদের যদি আসতে না দিতাম! আরও কিছুদিন তোরা আমার কাছে থেকে যেতে পারতিস। মেয়েটা কত সুস্থ, কত স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল।
বিনয় জবাব দেয়নি।
সুধা একটানা বলে গেছে, ঝিনুককে বাবার কাছে না নিয়ে এলে এমন বিপদ ঘটত না।
বিনয় বলেছে, তোদের ওখানে চিরকাল তো থাকা যেত না। এক, দেড় মাস না হয় তোর দাদাশ্বশুরের আসা পিছিয়ে গেছে। তারপর কী হতো?
সুধা চুপ করে থেকেছে।
বিনয় বলেছে, তাছাড়া বাবা ফিরে এসেছে। তারপর তোদের ওখানে কি আর থাকা যায়?
সুধা একটু ভেবে বলেছে, বাবার যে এতটা পরিবর্তন হবে, চিন্তা করতে পারিনি। কত উদার ছিলেন। ভেবেছিলাম ধর্মকর্ম করছেন। কিন্তু সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারলেন না।