বাইরের ঘরে এনে বিনয়কে বসানো হল। হিরণরাও বসেছে। মুহূর্তের জন্যও ভাইয়ের মুখ থেকে চোখ সরায়নি সুধা। সে কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিনয় বলে, ঝিনুক কি তোদর এখানে এসেছে?
হিরণ সুধা, দুজনেই চমকে ওঠে। সুধা বলে, না। তোর সঙ্গে এই কিছুক্ষণ আগে ও-বাড়িতে গেল। একা একা এখানে ফিরে আসবে কেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
ভাঙা ভাঙা, আবছা গলায় বিনয় বলল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।
হতচকিত সুধা প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী বলছিস বিনু!
হিরণ ধীর, স্থির, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হয় না। সেও বিহুলের মতো বলে, কোথায় যাবে ঝিনুক? তোমাদের বাড়িটা ভাল করে খুঁজে দেখেছ?
একতলা থেকে তেতলা অবধি সবগুলো ঘর, বারান্দা, প্যাসেজ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে।
হঠাৎ কী এমন হল যে, ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল? ও-বাড়িতে ওকে নিয়ে যাওয়ায় তোমার বাবা কি খুশি হননি? মানে, উনি হয়তো ঝিনুককে — কথা শেষ না করেই থেমে গেল হিরণ।
হিরণের ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়ার সঠিক কারণটা ধরে ফেলেছে সে। বিনয় তক্ষুনি উত্তর দেয় না। অদ্ভুত এক কষ্ট তার গলার ভেতর জমাট বাঁধতে থাকে। অনেকক্ষণ পর সে ধীরে ধীরে শুরু করে। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে ঝিনুককে নিয়ে সন্ধেবেলায় অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার পর থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, সব জানিয়ে বলে, ঝিনুকের খোঁজে বাবা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিল। বাবাকে গিয়ে খবরটা দিই, ও এ-বাড়িতে আসেনি।
শুনতে শুনতে শ্বাসক্রিয়া যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সুধার, হিরণের। ফুসফুসে জোরে বাতাস টেনে হিরণ বলল, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই
বিনয় উঠে পড়েছিল, না না, এত রাতে আপনাকে যেতে হবে না। ট্রাম বাস চলছে। আমি নিজেই চলে যেতে পারব।
সুধা আর হিরণও উঠে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত সুধা জিজ্ঞেস করল, ঝিনুককে কি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে?
এতক্ষণ নিজেকে অনেকখানি সংযত রেখেছিল বিনয়। এবার উন্মাদের মতো মাথা ঝাঁকাতে থাকে, জানি না, জানি না, জানি না–
.
০২.
সেই যে ঝিনুক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল তারপর কদিন কেটে গেল। বিনয় প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে অবনীমোহনের কাছেই আছে। সারাক্ষণ উভ্রান্তের মতো অবস্থা। সকালের দিকে বেলা একটু বাড়লে সে সোজা থানায় চলে যায়। ফের যায় সন্ধেবেলায়। যদি ঝিনুকের কোনও খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নেহাতই দুরাশা।
ওসি দিবাকর পালিত অত্যন্ত ভদ্র, ভালমানুষ। পুলিশ বলতে যে রুক্ষ, কর্কশ, হাড়হিম করা একটা চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে তার সঙ্গে এঁর আদৌ মিল নেই। খুবই সহানুভূতিপ্রবণ। বিনয় থানায় এলে তাকে যত্ন করে বসান। তার কথাবার্তায় সহৃদয়তার ছাপ, গভীর সমবেদনা।
যখনই বিনয় থানায় আসে, বিব্রতভাবে দিবাকর বলেন, না, কোনও খবর নেই। একটি মেয়ে হিমঋতুর এক সন্ধ্যায় কলকাতার মতো বিপুল শহরে বিলীন হয়ে গেছে, অথচ সুশৃঙ্খল, রিশাল পুলিশবাহিনী তাকে খুঁজে বার করতে পারছে না, এ লজ্জা, এ গ্লানি যেন তারই।
বিনয় করুণ মুখে বলে, আপনাদের লোকজনকে একটু ভাল করে খোঁজ নিতে বলুন স্যার। এই একই কথা রোজই বলে সে। একই ধরনের কাকুতি মিনতি।
কোমল স্বরে দিবাকর বলেন, আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই বিনয়। শুধু কলকাতা পুলিশ নয়, সারা ওয়েস্টবেঙ্গল পুলিশকেও অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঝিনুকের খবর পাওয়ামাত্র তোমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেব।
তা তো বলেছেনই। তবু ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে। খেতে পারি না, ঘুমোতে পারি না। কীভাবে যে আমার দিন কাটছে বলে বোঝাতে পারব না।
স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারি বিনয়।
বিনয় বলে, সেই জন্যে আপনার কাছে চলে আসি।
দিবাকর বলেন, যখন ইচ্ছে, আসবে। মেয়েটাকে যতক্ষণ না ফিরে পাচ্ছি, আমাদেরও স্বস্তি নেই।
একটু চুপ করে থাকে বিনয়। তারপর বলে, আমি যে রোজ দুবার করে আসি, বিরক্ত হন না তো স্যার?
বিনয়ের একটা হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিয়ে দিবাকর বলেন, দুবার কেন, দশবার আসবে। আমাদের কাজ হল মানুষকে সাহায্য করা। কিন্তু ঝিনুকের বেলায় কিছুই করতে পারছি না। মেয়েটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হয় বিনয়। পুলিশবাহিনীর অক্ষমতা তাঁকে বিমর্ষ করে তোলে।
শুধু দুবেলা থানাতেই হাজিরা দেয় না বিনয়। সময়ে অসময়ে যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ঘুরতে থাকে কখনও ট্রামে, কখনও বাসে। কখনও বা অলিগলির সহস্র পাকে জড়ানো মহানগরীর নানা প্রান্তে, পায়ে হেঁটে। চতুর্দিকে অজস্র মানুষ। ভিড়ের ভেতর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রিয় নারীটির মুখ খুঁজে বেড়ায় সে।
.
ঝিনুকের অদৃশ্য হবার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল আনন্দ, সুনীতি আর ঝুমা। তাছাড়া অবনীমোহন দীর্ঘ তীর্থভ্রমণের পর কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তার সঙ্গেও দেখা করা দরকার। সবাই জানে কিছুদিন পর চিরকালের জন্য তিনি তার গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন। আর কখনও ফিরবেন কি না, ফিরলেও কবে ফিরবেন, তার ঠিক নেই।
অবনীমোহনের সঙ্গে দেখা করার চেয়েও ঝিনুকের নিখোঁজ হওয়াটা অনেক বিরাট আকারে, অনেক বেশি সংকট নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দও সমানে ঝিনুকের খোঁজখবর চালিয়ে যাচ্ছে। তার চেহারার বিবরণ দিয়ে কতজনকে যে সন্ধান নেবার কথা বলেছে তার ঠিক নেই।