দিবাকর মৃদু হাসলেন, আশা তো করছি। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি হবে না। তারপর দেখা যাক।
আমার ছোট মেয়ের বাড়িতে টেলিফোন নেই। সেখানে কারওকে পাঠাতে হবে। আপনাদের এখান থেকে বড় মেয়েকে একটা ফোন করা যাবে?
অবশ্যই। করুন না–
এক্সচেঞ্জে ধরে সুনীতিদের বাড়িতে যোগাযোগ করলেন অবনীমোহন। ওধারে আনন্দ লাইনটা ধরেছিল। ঝিনুকের কথা শুনে সে হকচকিয়ে যায়। উদ্বেগের সুরে জানায়, ঝিনুক তাদের বাড়ি যায়নি। জিজ্ঞেস করলে, আমি কি চলে আসব?
অবনীমোহন বললেন, এই রাত্তিরবেলা এসে আর কী করবে? আসার দরকার নেই।
আনন্দ বলল, এক্ষুনি থানায় জানানো খুব জরুরি।
বিনু আর আমি ভবানীপুর থানায় এসেছি। সেখান থেকেই কথা বলছি।
আপনি আমাকে এখন কী করতে বলেন?
আপাতত কিছু করার নেই। তেমন বুঝলে পরে তোমাকে জানাব।
আমরা ভীষণ চিন্তায় থাকব। ঝিনুকের খবর পেলে তক্ষুনি আমাদের ফোন করবেন।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে আনন্দর সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে, ওসিকে জানিয়ে দিলেন অবনীমোহন। জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমাদের কী করণীয়?
দিবাকর বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এখন বাড়ি যান। দুচার দিনের ভেতর মেয়েটাকে পাওয়া না গেলে খবরের কাগজের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞাপন দিতে হবে।
ঠিক আছে। দেব। আচ্ছা চলি
আসুন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অবনীমোহন বললেন, বিনু রোজ একবার এখানে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করে খবর নিয়ে যাবে।
দিবাকর বললেন, আপনাদের দুশ্চিন্তার কারণটা বুঝি। বেশ, ছেলেকে পাঠাবেন।
থানার বাইরে এসে ধরা গলায় অবনীমোহন বললেন, মেয়েটার কী ক্ষতি যে করে ফেললাম। আক্ষেপ আত্মগ্লানি অপরাধবোধ, সব একাকার হয়ে তার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে এল।
বিনয় উত্তর দিল না।
থানার সামনেই ট্রাম রাস্তা। নীরবে ওপারে গিয়ে অবনীমোহন বললেন, এক কাজ কর বিন
কী? জিজ্ঞাসু চোখে বাবার দিকে তাকায় বিনয়।
রাত খুব একটা বেশি হয়নি। তুই একবার সুধাদের বাড়ি চলে যা। দেখে আয় ঝিনুক ওখানে গেছে কি না।
যদি ছোটদির ওখানে গিয়ে থাকে, কী করব?
বিনয় যে ইঙ্গিতটা দিয়েছে, নিমেষে বুঝে নিয়েছেন অবনীমোহন। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা হলে সে তাকে ফিরিয়ে আনবে কি না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, আগে খবরটা নিয়ে আয়। তারপর দেখি কী করা যায়–
দ্বিধাটা এখনও কাটেনি অবনীমোহনের। ধর্ষিত মেয়েটিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি মনস্থির করতে পারেননি। ঝিনুকের সন্ধানে ছেলেকে যে সুধাদের কাছে পাঠাতে চাইছেন, তার পেছনে রয়েছে খুব সম্ভব ক্ষণিকের অনুশোচনা। বিনয় এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকালো। কোনও উত্তর দিল না।
বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। টালিগঞ্জের ট্রাম এসে গেল। বিনয়কে ট্রামে তুলে দিয়ে অবনীমোহন বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
.
এখন রাস্তায় লোজন বেশ কমে গেছে। গাড়িটাড়িও তেমন চোখে পড়ে না। রাত যত বাড়বে, মানুষ এবং যানবাহন তত বিরল হতে থাকবে।
ধাতব শব্দ করে ট্রাম ছুটে চলেছে। দুচারটে বিড়ি সিগারেট কি চায়ের দোকান ছাড়া রাস্তার দুধারে বাকি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। হিম আরও ঘন হয়ে নামছে। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে হুস হাস ছুটে যাচ্ছে ছাদ-খোলা দোতলা বাস, উলটো দিকের ট্রাম, প্রাইভেট কার কি ঘোড়ার গাড়ি।
একটা জানালার ধারে বসে ছিল বিনয়। হুহু উত্তরে বাতাস মুখেচোখে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে। ঠাণ্ডায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। জানালাটা যে বন্ধ করে দেবে, সেদিকে লক্ষ নেই। তার অবিরাম একটাই চিন্তা, সুধাদের বাড়িতে ঝিনুককে পাওয়া যাবে কি? বিনয় প্রায় নিশ্চিত, ঝিনুক ওখানে যায়নি। তবু একবিন্দু অলীক দুরাশা বুকের ভেতর যেন ধুকধুক করে। যদি গিয়ে থাকে?
টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের তলা দিয়ে ট্রাম একসময় সুধাদের বাড়ির কাছাকাছি স্টপেজটায় এসে থামতেই নেমে পড়ল বিনয়। ব্রিজের ওধারের তুলনায় এদিকটায় আলো অনেক কম। সব কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা। চারদিকের বাড়িটাড়ি এবং টিনের চালের চাপ-বাঁধা বস্তি ভুতুড়ে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কুয়াশা আর আলো-আঁধারি ভেদ করে সুধাদের বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়ল বিনয়। একটু পর সদর দরজা খুলে দিল উমা। বিনয়কে দেখে সে ভীষণ অবাক। সন্ধেবেলায় ঝিনুককে নিয়ে যে চলে গিয়েছিল, দু-আড়াই ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই আচমকা সে ফিরে আসবে, উমা ভাবতে পারেনি।
প্যাসেজে আলো জুলছিল। উমার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতে বিনয় ডাকতে লাগল, ছোটদি, হিরণদা–
ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে হিরণ আর সুধা প্রায় ছুটতে ছুটতে সিঁড়ির মুখে চলে এল। বিনয়কে দেখে উমার মতো তারাও হতবাক। বিস্ময় একটু থিতিয়ে এলে সুধা জিজ্ঞেস করল, তুই চলে এলি! ঝিনুক কোথায়? বাবার সঙ্গে বলতে বলতে বিনয়ের মুখের দিকে ভাল করে নজর পড়তেই থমকে গেল। চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্ত চেহারা। দেখেই টের পাওয়া যায়, তার ওপর দিয়ে এলোপাতাড়ি ঝড় বয়ে গেছে।
রুদ্ধ গলায় সুধা বলল, কী হয়েছে রে বিনু?
হিরণ একদৃষ্টে বিনয়কে লক্ষ করছিল। সুধাকে বলল, আগে ঘরে এসে বিনু বসুক। তারপর যা জিজ্ঞেস করার কোরো।