দিবাকর বললেন, এর কথা বোধহয় আপনার মুখে শুনেছিলাম। বিনয়কে বললেন, পাকিস্তানে থাকা গেল না বুঝি?
আস্তে মাথা নাড়ল বিনয়।
অনেকটা আপন মনেই এবার দিবাকর বললেন, ওখানকার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রোজ হাজার হাজার রিফিউজি চলে আসছে ইন্ডিয়ায়। এই মানুষগুলোর কী যে ভবিষ্যৎ!
একটু চুপচাপ।
তারপর দিবাকর অবনীমোহনকে বললেন, এবার আপনার প্রয়োজনের কথাটা শোনা যাক।
নানা সংকটের ভেতর দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে ঝিনুকের এপারে চলে আসা থেকে শুরু করে কিছুক্ষণ আগে তার নিরুদ্দেশ হওয়া পর্যন্ত বিশদভাবে সব বলে গেলেন অবনীমোহন। অবশ্য ঝিনুকের ধর্ষিত হবার ঘটনা আর হেমনলিনীর নির্দয় ব্যবহারটুকু বাদ দিয়ে।
শান্ত মানুষটিকে এবার বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। দিবাকর বললেন, হঠাৎ আপনার বাড়ি থেকে মেয়েটি চলে গেল। কী হয়েছিল?
বিব্রত অবনীমোহন এক পলক ছেলেকে দেখে নিয়ে বললেন, তেমন কিছুই হয়নি। তিনি যে অস্বস্তি বোধ করছেন, চোখেমুখে তা ফুটে উঠেছে।
দিবাকর অবনীমোহনকে লক্ষ করেননি। চিন্তিতভাবে বললেন, কোথায় যেতে পারে বলে আপনাদের ধারণা?
কোনও ধারণাই নেই। কলকাতায় এই প্রথম এসেছে, এখানকার পথঘাট কিছুই চেনে না। তার ওপর এই ঠাণ্ডার রাত। কী যে হবে, ভাবতেই পারছি না।
আপনি বলেছেন, পাকিস্তান থেকে আসার পর ঝিনুক আপনার দুই মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। ওই দুজায়গায় খোঁজ নিয়েছেন? যদি ওদের কারও কাছে গিয়ে থাকে–
বিনয় জানে প্রাণ গেলেও সুনীতিদের বাড়ি যাবে না ঝিনুক। সেখানে তাকে যে অসম্মান করা হয়েছে, হেমনলিনী যেভাবে তাকে আবর্জনার মতো একধারে ফেলে রেখেছিলেন, সেখানে যাবার প্রশ্নই নেই। ঝিনুকের অভিমান এবং আত্মসম্মানবোধ খুবই প্রখর। তবে সুধাদের বাড়ি গেলেও যেতে পারে। সুধা আর হিরণ অপার মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। লহমার জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিল পুরানো দুঃস্বপ্নের যাবতীয় স্মৃতি। কলকাতায় ওটাই একমাত্র ভূখণ্ড যেখানে নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারবে ঝিনুক। কিন্তু এই হিমঋতুতে গাঢ় কুয়াশায় যখন চতুর্দিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে, পথ চিনে চিনে তার পক্ষে টালিগঞ্জে পৌঁছনো সম্ভব? বিনয় আন্দাজ করতে পারে, বাড়ি থেকে ঝিনুক যখন বেরোয় তখন তার মাথার ঠিক ছিল না। আচমকা আঘাতে তখন তার পাগল পাগল, উদভ্রান্ত অবস্থা। শিরা-উপশিরার মতো এই শহরে কত যে রাস্তা! পাকে পাকে জড়ানো কত গলিঘুজি! কোন পথ ধরে এই জটিল গোলকধাঁধায়, কোথায় যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে, কে জানে।
অবনীমোহন বলছিলেন, না। খোঁজ নেওয়া হয়নি। আমার মেয়েদের কাছে গেলে নিশ্চয়ই ওরা। জানাতে।
দিবাকর বললেন, তবু আজই মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমনও হতে পারে সে ওই দুটো জায়গার কোথাও এখনও পৌঁছতে পারেনি।
ঠিক আছে, যোগাযোগ করব।
আমিও কলকাতার সব থানায় জানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটি সম্পর্কে ডিটেলে বলুন। নাম তো বললেন ঝিনুক। ওটা নিশ্চয়ই ডাক-নাম। ভাল নাম কিছু আছে?
আছে। তাপসী লাহিড়ি।
শুধু নামই নয়, বয়স, হাইট, রং, চেহারার খুঁটিনাটি বর্ণনা, আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য যেমন শরীরের খোলা অংশে জড়ল, জন্মদাগ, কাটার চিহ্ন আছে কি না–সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে দিবাকর বললেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভেতর থেকে একটি মেয়েকে খুঁজে বার করা তো সহজ নয়। তাই এত ডিটেল দরকার। ওর কোনও ফোটো দিতে পারেন?
অবনীমোহন বিনয়ের দিকে তাকালেন। ঝিনুকের ফোটো থাকলে বিনয়েরই জানার কথা। রাজদিয়ার মানুষদের ছবিটবি তোলার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ বা শখ ছিল না। সুযোগ ছিল তার চাইতেও কম। ফোটো তুলতে হলে যেতে হতো নারায়ণগঞ্জ কি ঢাকায়। ঝিনুকের বালিকা বয়সে ভবতোষ দুএকবার ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ফোটো তুলেছিলেন। কিশোরী বয়সের তিন-চারখানা ছবিও আছে তার। সুধা সুনীতির বিয়ের সময় দুজোড়া বর কনেকে ঘিরে কে যেন কটা গ্রুপ ফোটো তুলেছিল। এইসব ছবির কপি বাঁধিয়ে হেমনাথদের বাড়িতে রাখা আছে। বিনয়ের স্পষ্ট মনে আছে, ঝিনুকের তরুণী বয়সের কোনও ফোটো নেই। সে যখন কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে সেই সময়টা সারা দেশ জুড়েই মহাসংকট। যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ব্রিটিশ আর আমেরিকান টমিরা ভারতবর্ষের ব্যারাকগুলো ফাঁকা করে প্লেন কি জাহাজ বোঝাই হয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের নিজের দেশে। ইংরেজরা বুঝতে পারছিল, কয়েক হাজার মাইল দূরের এই উপমহাদেশে কলোনি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মিত্রশক্তি জিতেছে ঠিকই, কিন্তু জার্মান বোমায় অর্ধেক লন্ডন ধ্বংসস্তূপ। অর্থনীতি ফোপরা হয়ে গেছে। তারা চাটিবাটি গুটিয়ে ভারতবর্ষ ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছে।
যুদ্ধের ডামাডোল কাটতে না কাটতেই শুরু হল দাঙ্গা, ধর্ষণ, আগুন, ব্যাপক গণহত্যা, অবশেষে দেশভাগ। এর মধ্যে ছবি তোলার মতো শখ কার প্রাণেই বা থাকতে পারে? ঝিনুকের ছেলেবেলা বা কিশোরী বয়সের কোনও ছবিই পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসেনি বিনয়। আনলেই বা কাজের কাজ কতটুকু হতো? তরুণী হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের আদল অনেকখানিই বদলে গেছে।
বিনয় বলল, না, ফোটো নেই।
দিবাকর বললেন, থাকলে সুবিধা হতো। যাক, মেয়েটির যে ডেসক্রিপশন শুনলাম, অন্য থানাগুলোতে তা-ই জানিয়ে দেব।
অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটাকে পাওয়া যাবে তো দিবাকরবাবু? তার বলার মধ্যে সংশয় আর উৎকণ্ঠা মেশানো।