বাসমতীরা আউড়ে যায়,
ওঁ নারায়ণায় নমঃ
ওঁ গণেশায় নমঃ
ওঁ গণেশায় নমঃ
ওঁ মহাদেবায় নমঃ
এরপর আরও কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ে যোগেনের হাতটা নামিয়ে দিয়ে উদ্বাস্তুদের ভিড়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে, বিয়া অইতে আছে কিন্তুক শঙ্খ নাই। শঙ্খ না ফুয়াইলে (ফু দিলে) কি বিয়া হয়? হে আর কী করন? নাই তো নাই। মায়েরা, তোমরা হগলটি জোকার (উলু) দাও।
চতুর্দিক থেকে মিষ্টি সুরে উলুর আওয়াজ উঠতে থাকে। আর তারই মধ্যে গলার স্বর উঁচুতে তুলে রসিক জয়ধর বলে যায়, অস্য ফাল্গুন মাসি, শুক্লপক্ষে, নিশাকালে বাসমতী বিশ্বেসের লগে
বিনয় অবাক। বাংলা ক্যালেণ্ডারে এটা কার্তিক মাস, এখন ভর দুপুর। আর লোকটা বলছে কি না ফাল্গুন মাস, নিশাকাল, ইত্যাদি। খুব সম্ভব একটা মন্ত্রই শিখে রেখেছে রসিক। যে মাসেই বিয়ে হোক-বৈশাখ কি শ্রাবণ, মাঘ বা ফান, দিনে কি রাতে, তপক্ষে বা কৃষ্ণপক্ষেওই এক লাচাড়ি পড়ে যাবে সে।
বঙ্গোপসাগরের এক নির্জন দ্বীপে, অদ্ভুত এই বিয়ে, মন্ত্রোচ্চারণ, উলুধ্বনি–সব কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয় বিনয়ের। আবার মজাও লাগছে। এধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে তার চোখ চলে যায় মেয়েদের জটলাটার দিকে। কুমারী মেয়েদের মুখ খোলা। তবে বিবাহিতাদের সবার মাথাতেই ঘোমটা। কারও নাক অবধি ঢাকা, কারও বা কপাল অবধি।
হঠাৎ একটা মুখের ওপর নজর আটকে যায় বিনয়ের। পুরো মুখ নয়– একটা চোখ, কপাল চিবুক এবং নাকের খানিকটা অংশ। বাকিটা ঘোমটায় ঢাকা খুবই চেনা চেনা। এ কে? ঝিনুক কী? পাঁচদিন আগে খিদিরপুর ডকে মহারাজা জাহাজে উদ্বাস্তুরা যখন উঠছিল, ঝিনুকের মতোই একজনকে দেখেছিল সে। পরে জাহাজের খোলে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। এখন যাকে দেখা যাচ্ছে তার চোখে গালে চিবুকে ঝিনুকেরই আদল। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যেতে থাকে বিনয়ের।
ওই মেয়েটির কাছে সোজাসুজি যাবার উপায় নেই। মাঝখানে বিয়ের আসর। সেটা ঘিরে উদ্বাস্তুরা বসে আছে বৃত্তাকারে। ভিড়ের পেছন দিয়ে পেছন দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বিনয় যখন ওধারে পৌঁছল, মেয়েটাকে আর দেখা গেল না। সে কি এর মধ্যে সারা মুখে ঘোমটা টেনে দিয়েছে?
সারি সারি অগুনতি ঘোমটা-ঢাকা মেয়েমানুষদের মধ্যে কে যে ঝিনুক (আদৌ যদি ঝিনুক হয়), জানার উপায় নেই। কারওকে তো বলা যায় না, তোমার মুখটা দেখব, ঘোমটা খোল। বিনয় চাপা, ব্যাকুল স্বরে ডাকতে লাগল, ঝিনুক-ঝিনুক- কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না।
হতাশ বিনয় কিছুক্ষণ বাদে বিশ্বজিৎদের কাছে ফিরে আসে। এদিকে হরিপদ আর বাসমতীর মালাবদল, শুভদৃষ্টি ইত্যাদি শেষ হয়ে গেছে। এখন দুনম্বর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না বিনয়। চারপাশে এত কলরোল, রসিক জয়ধরের তেজী গলার মন্ত্রপাঠ সে-সবের একটি শব্দও তার কানে ঢুকছে না।
রসিক করিৎকর্মা লোক। এক ঘণ্টা সাত মিনিটের ভেতর ছটা বিয়ে চুকিয়ে ফেলল। এক শ ডি পি ফ্যামিলির কোটাও পূর্ণ হয়ে গেল।
.
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেয় ইন্টার-আইল্যাণ্ড শিপ সারভিসের চলুঙ্গা নামের মাঝারি আকারের জাহাজটি এসে ভিড়ল রস আইল্যাণ্ডে। এই জাহাজটা আন্দামান ও নিকোবরের নানা দ্বীপে মালপত্র। এবং যাত্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চলুঙ্গা পঞ্চাশটি উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে এখান থেকে আজ যাবে মধ্য আন্দামানে। কোন কোন পরিবার যাবে, বিশ্বজিৎ রাহা এবং পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য অফিসাররা ঠিক করে দিয়েছেন।
সুর্যের গনগনে, কাকে খাই কাকে খাই চোষা এখন অনেক বদলে গেছে। পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোর আড়ালে সেটা নেমে যাচ্ছে। রোদের তাপ জুড়িয়ে গেছে অনেকটাই। জাদুকলস উপুড় করে কারা যেন সমুদ্রে সোনা ঢেলে চলেছে অবিরল।
চলুঙ্গা জাহাজ থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল দ্বীপে। নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কজন কর্মী তালিকা দেখে হেঁকে হেঁকে পঞ্চাশটি পরিবারকে জাহাজে তুলতে লাগল। খিদিরপুর ডকে যেভাবে ভোলা হয়েছিল, হুবহু সেই পদ্ধতিতে। উদ্বাস্তুরা সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক উঠে যাচ্ছে।
বিদায় জানাতে বিশ্বজিৎ, সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেবরা জাহাজের কাছে চলে এসেছেন। তাদের সঙ্গে বিনয়ও রয়েছে।
আধঘণ্টাও লাগল না, পঞ্চাশটি ফ্যামিলির প্রায় আড়াই শটি মানুষ জাহাজে উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কাঠের সিঁড়িও তুলে ফেলা হল।
তারপর দশ দিগন্ত সচকিত করে গম্ভীর ভো বাজিয়ে এস এস চলুঙ্গা চলতে শুরু করে। জলযানটার আপার ডেকের রেলিং ধরে বেশ কিছু উদ্বাস্তু রস-এর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তাদের ভেতর ঝিনুককে দেখতে পেল বিনয়।
খিদিরপুর ডকে মুখের একটা অংশ চোখে পড়েছিল। খানিক আগে হরিপদদের বিয়ের আসরে ঘোমটার খানিকটা আবরণ ছিল। এখন ঘোমটা টোমটা নেই। পরিপূর্ণ মুখখানাই দেখা যাচ্ছে। এ কদিন বিনয়ের মনে যে সংশয়টুকু ছিল তা মুহূর্তে উধাও। চিরদিনের চেনা সেই ঝিনুকই। মহারাজা জাহাজে কিংবা খানিক আগে রস দ্বীপে বিনয় তাকে এত খোঁজাখুঁজি করেছে। ডেকেছেও কিন্তু ঝিনুক সাড়া দেয়নি, কাছে আসেনি। নিশ্চয়ই ক্ষোভে, দুঃখে, নিদারুণ অভিমানে। কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে এত স্পষ্ট করে বিনয় তাকে দেখল! বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, মজ্জা কুঁড়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কী যে তীব্র আকুলতা!