কোটার এক শ ফ্যামিলি পূর্ণ করতে হবে, তাই রাহারা কেউ টু শব্দটি করলেন না।
এদিকে যোগেনের প্রশ্নের শেষ নেই। সে বলল, মশয়, আমার জমিনে এটু লাঙ্গল টাঙ্গল দিয়া দিতে পারবেন তো?
এখনও জমি পাওয়া যায়নি, কিন্তু আগে থেকেই ভাবী জামাইকে চাষ করে দেবার কড়ার করিয়ে নিচ্ছে যোগেন। হরিপদও একটি আস্ত ঘুঘু। সে বলে, বিদ্যাশি (বিদেশে) আত্মবান্ধবেরে দেখতি হবে না? বিয়ে হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই সে যোগেনদের নিজের পরমাত্মীয় বানিয়ে ফেলেছে।
যোগেন রাহাদের দিকে ফিরে জানিয়ে দিল, পাত্র পছন্দ হয়েছে। এ বিয়েতে তার আপত্তি নেই।
নিরঞ্জন খুবই তুখোড়। ভেলকির পর ভেলকি দেখিয়ে পরের পাঁচজোড়া যুবক-যুবতীর বিয়েও পাকা করে ফেলল। অবিকল একই প্রক্রিয়ায়।
আন্দামানের মাটিতে নামতে না-নামতেই একসঙ্গে ছছটি বিয়ের মতো ঘটনা ঘটতে চলেছে। খবরটা অন্য উদ্বাস্তুদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। ঘুম টুম চোখ থেকে ঝেড়ে ফেলে তারা এসে নিরঞ্জনদের ছাতার সামনের দিকে ভিড় জমায়। তাদের চোখে একই সঙ্গে অপার কৌতূহল এবং উত্তেজনা।
হঠাৎ জমায়েতের ভেতর থেকে একটা লোক উঠে আসে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। ভারী শরীর। সারা গায়ে প্রচুর পাকা লোম, কান এবং নাকের ভেতর থেকেও লোমের গোছা বেরিয়ে এসেছে। পরনে ধুতি আর তালি-মারা নিমা (এক জাতীয় জামা)। নিমায় বোম নেই। ফলে বুকের ওপর আড়াআড়ি লালচে পৈতার গোছা দেখা যাচ্ছে। সে হাতজোড় করে, মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, পন্নাম ছারেরা, আমার নাম রসিক জয়ধর। দ্যাশ আছিল পাকিস্থানের ফরিদপুর জিলায়। দ্যাশে থাকতে পূজা-পাব্বন-ছাদ্দ-বিয়া, এই হগল কিয়াকম্ম করতাম। চাষবাসের লগে লগে পুরৈতগিরি (পুরোহিত গিরি) আছিল আমাগো প্যাশা। (পেশা)। তা ছারেরা, যে বিয়াগুলান আপনেরা ঠিক করছেন, আমি হেইগুলান দিতে চাই
ছজোড়া বর-কনে প্রস্তুত। একজন পুরুতও পাওয়া গেল। বিপুল উৎসাহে বিশ্বজিৎ রাহা বলে ওঠেন, নিশ্চয়ই দেবেন। কী কী করতে হবে বলুন
রসিক জয়ধর একটা ফর্দ তৈরি করে দিল। বাসি ময়লা কাপড় চোপড় পরে তো বিয়ে হয় না। বর-কনের জন্য নতুন শাড়িজামাটামা চাই। চাই টোপর, ফুলের মালা, শাঁখা সিঁদুর, নোয়া, পাত্র পাত্রী এবং পুরোহিতের জন্য আসন, উপহারের জিনিসপত্র, ইত্যাদি।
ফর্দে চোখ বুলিয়ে মোটামুটি হিসেব করে নিলেন বিশ্বজিৎ। মোটামুটি সাত শ টাকা দরকার। অফিসার এবং পোর্ট ব্লেয়ারের অন্য যে-সব বাঙালি বাসিন্দারা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিল তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হল। এমন একটা শুভ কাজ। সবাই হাসিমুখে টাকা দিলেন। বিনয় দিল কুড়ি টাকা। সাত শর জায়গায় সাড়ে আটশ উঠে গেল।
চ্যাথাম বন্দরের যাবতীয় জাহাজ, স্টিমলঞ্চ, মোটর বোট«বার-মাস্টার সেনসাহেবের অধীনে। বস আইল্যাণ্ডে যে মোটর বোটটি রয়েছে, হারবার মাস্টার সেন সাহেবের অনুমতি নিয়ে পুনর্বাসন বিভাগের দুজন কর্মী, নিতাই কুণ্ডু আর রমেশ নাহাকে সেটায় করে পোর্টব্লেয়ারে এবারডিন মার্কেটে পাঠিয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ। সঙ্গে দিলেন রসিকের ফর্দ এবং টাকা। নিতাইরা লিস্ট মিলিয়ে জিনিসপত্র তো আনবেই। শুভ বিবাহে মিষ্টিমুখ না হলে চলে? এবারডিন বাজারে কিছুদিন হল এক বাঙালি ময়রা মিঠাইয়ের দোকান খুলেছে। নিতাইদের বলে দেওয়া হল, সের দশেকের মতো রসগোল্লা যেন নিয়ে আসে।
রস থেকে উপসাগর পেরিয়ে পোর্টব্লেয়ার যেতে দশ মিনিট, কেনাকাটা সারতে চল্লিশ মিনিট, ফিরে আসতে আরও দশ মিনিট। মোট ষাট মিনিট অর্থাৎ এক ঘণ্টা লাগল নিতাইদের। টাটকা ফুলের মালা পাওয়া যায়নি। তাই এক ডজন কাগজের ফুলের মালা এনেছে ওরা। আসলের বদলে নকল। কিন্তু কী আর করা যাবে? মন শুদ্ধ থাকলে ওতেই চলে যাবে।
নিতাইরা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণোদ্যমে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ছজোড়া বর-কনের সাজগোজ করতে সময় লাগল ঠিক সতেরো মিনিট।
এখন দুটো বেজে আটান্ন। সূর্য একনাগাড়ে আগুন ঢেলে চলেছে। সমুদ্রের নোনা জল ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। ধারে কাছে সি-গাল বা অন্য কোনও পাখি নেই। এলাকা ছেড়ে সব উধাও হয়েছে।
ঝলসানো আকাশের নিচে আন্দামানের এক সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে বিয়ের আসর বসল।
প্রথম বিয়েটা হবে হরিপদ আর বাসমতীর। চারখানা নতুন আসন পাতা হয়েছে। পাত্র-পাত্রী বসেছে মুখোমুখি। তাদের একপাশে পুরুত রসিক জয়ধর। আর-এক পাশে যোগেন বিশ্বাস। সে কন্যা সম্প্রদান করবে।
আসরের চারপাশে ঠাসাঠাসি ভিড়। বিয়ে ব্যাপারটার ভেতর বুঝি বা কোনও ম্যাজিক থাকে। যে উদ্বাস্তুরা পাঁচটা দিন জাহাজে ভয়ে আতঙ্কে সিটিয়ে ছিল, তাদের এখন চেনাই যায় না। এধারে ওধারে চলছে অবিরল কলকলানি। সেই সঙ্গে হাসি। হা হা, হি হি। আর টুকরো টুকরো মজাদার সব মন্তব্য।
বিশ্বজিৎ রসিক জয়ধরকে বললেন, ঠাকুর মশাই, হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই। বিকেলের মধ্যে বিয়েগুলো সেরে ফেলতে হবে।
রসিক বলল, চিন্তা কইরেন না ছার। এক-একহান বিয়া বারো চৈ মিনিটে নামাইয়া দিমু। বলেই হরিপদর একখানা হাত টেনে নিয়ে তার ওপর বাসমতীর হাত রাখে। বর-কনের হাতের ওপর যোগেনকে হাত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলে, আমার লগে মন্তর পড়। কও ওঁ নারায়ণায় নমঃ।