কাছাকাছি একটা পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে রোগা প্যাংলা গোছের এক যুবক খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। নামটা কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে আসে। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে সে। সারা শরীর কাঁপছে। হাতজোড় করে ভয়ার্ত সুরে বলে, ছারেরা (স্যারেরা), এত রিফুজ থাকতি আমারি ডাকতিছেন কেন? আমি তো জেবনে অল্যায় কিছু করি নাই
নিরঞ্জন সহৃদয় ভঙ্গিতে বলে, ডরাও ক্যান? তোমার লগে কামের কথা আছে
না ছার, আমারে ছাড়ি দ্যান-আমারে ছাড়ি দ্যান।
এইসময় ছুটতে ছুটতে একজন আধবয়সী রুণ চেহারার লোক এসে পড়ে। হতচকিত, শঙ্কাতুর। ব্যাকুলভাবে বলে, হরিপদ কী করিছে ছারেরা? কী করিছে?
নিরঞ্জন তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনে ক্যাঠা (কে)? এহানে কী চাই?
লোকটা জানালো তার নাম গদাধর বিশ্বাস। সে হরিপদর দাদা। নিরঞ্জন বলে, আপনে আইছেন, ভালই অইছে।
এরপর কিছুক্ষণ কথা হল। কোথায় দেশ ছিল গদাধরদের? কতদিন আগে পাকিস্তান থেকে এসেছে? দেশে থাকতে তারা কী করত–চাষবাস, না অন্য কিছু? ইত্যাদি ইত্যাদি।
লঘু চালে গল্প করে করে পরিবেশটা সহজ করে নিয়ে এবার হরিপদর দিকে তাকায় নিরঞ্জন, তোমারে ক্যান ডাকছি, এইবার হোননা। আমরা তোমার বিয়া দিতে চাই।
বিভা (বিয়ে)! এমন বিস্ময়কর শব্দ আগে কখনও বুঝি বা শোনেনি হরিপদ। অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হাত-পা-মাথা ঝাঁকিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। মারি ফেলান ছার, মারি ফেলান। টাস করি বাড়ি মারি শ্যাষ করি ফেলান। গুলি করি হাগরের (সাগরের) জলে ভাসায়ে দ্যান। বিভা আমি করতি পারফ (পারব না।
হরিপদর সঙ্গে তার দাদাও সুর মেলায়, মারি ফেলান ছারেরা, মারি ফেলান। মাথায় বাড়ি মারি–
আচমকা বিয়ের প্রস্তাবে বেজায় ভড়কে গেছে ওরা। দুজনকে ধাতস্থ করতে বেশ সময় লাগল। হরিপদ যখন বুঝতে পারল, নিরঞ্জনদের কোনওরকম দুরভিসন্ধি নেই, তখন বলল, মনে তো বিভার বাসনা আছে, কিন্তুক মিয়া ছাওয়াল (মেয়ে) পাই কোয়ানে (কোথায়?
গদাধরও জানায়, সমস্যা একটাই। পাত্রী কীভাবে পাওয়া যাবে?
নিরঞ্জন হরিপদকে বলল, হেই চিন্তা আমাগো। মাইয়া আমরা ঠিকই জুটাইয়া দিমু। তুমি যে বিয়া করতে রাজি অইছ, এ আমাগো চৈদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। এটু খাড়াও বলেই খানিক আগের মতো মুখের সামনে দুই হাতের চোঙা বানিয়ে হাঁক পাড়তে থাকে, যোগেন বিশ্বাস–যোগেন বিশ্বাস
ডান পাশে একটু ঢালুমতো জায়গায় প্রচুর নারকেল গাছের জটলা। সেখানে শুয়ে ছিল যোগেন। লোকটা আধবুড়ো। মাথায় উষ্কখুষ্ক কাঁচাপাকা চুল। গালে সাত-আট দিনের খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে ময়লা খাটো ধুতির ওপর ফতুয়া। ডাক শুনে হরিপদদের মতোই হাই হাই করে চিকুর পাড়তে পাড়তে এসে হাজির। সে কী এমন অপরাধ করেছে যে এত এত রিফুজ থাকতে তাকে তলব করা হয়েছে? কেউ কি তার নামে ছারেদের কাছে কিছু লাগিয়েছে? সেইজন্য ছারেরা কি তার ওপর অসন্তুষ্ট? এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে যেতে লাগল যোগেন।
নিরঞ্জনের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। হরিপদদের মতোই বুঝিয়ে সুঝিয়ে যোগেনকে ঠাণ্ডা করল। তারপর বলল, আপনের কি একহান ডাঙ্গর (ডাগর) মাইয়া আছে?
যোগেন ঘাড় কাত করে জানায়, আছে তো। আপনি কেমন করি জানতি পারলেন?
টেবল থেকে উদ্বাস্তুদের নামের তালিকা তুলে ধরে নিরঞ্জন বলল, এইর ভিতরে আপনেগো বেবাক রিফুজির নাম ধাম লিখা আছে। তা মাইয়ার বিয়া দিবেন না?
দিতি তো চাই। কিন্তুক ছাওয়ালপান (পাত্র) পাই কোয়ানে (কোথায়)? হরিপদকে দেখিয়ে নিরঞ্জন বলল, দ্যাখেন তো ইয়ারে পছন্দ হয় কি না—
যোগেন বিশ্বাস এখন আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত উদ্বাস্তু নয়। সে এই মুহূর্তে একজন ভাবী শ্বশুর। লহমায় তার চেহারা বদলে যায়। বুকের ওপর আড়াআড়ি দুই হাত রেখে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হরিপদকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ভারিক্কি চালে শুরু করে, মশয়ের নাম?
হরিপদ মাথা নিচু করে কেঁচোর মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মিন মিন করে উত্তর দেয়, শিরি (শ্ৰী) হরিপদ বিশ্বেস
পিতা?
ঈশ্বর জগন্নাথ বিশ্বেস
নিবাস?
খুইলনে (খুলনা) জিলা। পাকিস্থান—
গেরাম?
আছেরপুর।
হরিপদর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল গদাধর। সে বলে, আমি হরিপদর বড় ভাই। যা জিগুবার (জিজ্ঞেস করার) আমারে জিগুতে পারেন। ও আমার ফেমিলির ছেলে।
ঘাড় টেরা করে যোগেন বলে, যা জিবার ছেলিরি (ছেলেকে) জিগুব বলে ফের সওয়াল শুরু করে, শিউলি, না ধানী?
ধানী।
কোন গুরুর শিষ্য? হরিচান (হরিচাঁদ), গুরুচান, না পাগলচান?
হরিচান।
বিনয় একধারে বসে এই বিচিত্র সওয়াল-জবাব শুনে যাচ্ছিল। ওদের মধ্যেও যে আলাদা আলাদা শ্রেণী আছে, আছে আলাদা আলাদা গুরু, এ-সব জানা ছিল না তার।
যোগেনের চোখমুখ দেখে মনে হল, সে খুশি। তারা যেমন পাত্র চায়, খাপে খাপে মিলে গেছে। এই ছেলেকে কন্যাদান করা যায়। সে এবার জিজ্ঞেস করে, মশয় তো আমার মেয়ারে (মেয়েকে) বিভা করতি চান, তা খাওয়াতি টাওয়াতি পারবেন?
হরিপদ যতই কেঁচো হয়ে থাকুক, ভেতরে ভেতরে খুবই ধুরন্ধর। সে রাহাদের দেখিয়ে বলল, এই ছারেরা মাথার উপুরি আছেন। তেনিরা থাকতি কি আপনের মেয়া রুপুস (উপোস) দিয়ি মরবে? ভাবী ধর্মপত্নীর ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব সে রাহাসাহেব সেনসাহেবদের ওপর সঁপে দিল।