বিশ্বজিৎরা জানালেন, তারা সবসময় উদ্বাস্তুদের পাশে আছেন। এবং থাকবেনও।
খাওয়া হয়ে গেলে শরণার্থীরা বেশির ভাগই চাঁদোয়ার তলায় শুয়ে পড়ল। কেউ কেউ নারকেলগাছের ছায়ায় বা বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিল।
উদ্বাস্তুদের পর বিশ্বজিৎরা খেয়ে নিলেন। সেই একই খাদ্যবস্তু। ভাত ডাল মাছ, ইত্যাদি।
চারদিকে অনেকগুলো বিশাল বিশাল রঙিন ছাতা দাঁড় করানো রয়েছে। সেগুলোর তলায় প্রচুর ফোল্ডিং চেয়ার এবং টেবল। অফিসাররা এবং অন্য সবাই যাঁরা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিলেন, খাওয়াদাওয়ার পর তারা এক-একটা ছাতার নিচে গিয়ে বসলেন। যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে, এখন একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার।
একটা ছাতার তলায় বসে ছিল বিনয়, নিরঞ্জন, বিশ্বজিৎ এবং আরও দু-একজন অফিসার।
এখন ভরদুপুর। সূর্য খাড়া মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তাপে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল গেজে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়, চোখ ঝলসে যাবে।
বিশ্বজিৎ ঘড়ি দেখে নিরঞ্জনকে বললেন, এখন বারোটা বেজে সাতান্ন। সাড়ে চারটেয় চলুঙ্গা জাহাজ আসবে। তোমরা যে রিফিউজিদের আজ নিয়ে এসেছ তার অর্ধেক নিয়ে চলুঙ্গা মিডল আন্দামানে যাবে
এই খবরটা বিনয়ের জানা। সে নীরবে শুনতে থাকে।
বিশ্বজিৎ বলছিলেন, তোমার কাছে তো রিফিউজিদের ফ্যামিলিগুলোর লিস্ট রয়েছে। দাও তো দেখি, কাদের ওখানে পাঠানো যায়।
টাইপ-করা তালিকাটি পকেট থেকে বার করে বিশ্বজিৎকে দিল নিরঞ্জন। সেটা দেখতে দেখতে বিশ্বজিতের ভুরু কুঁচকে গেল, এ কী, ছটা ফ্যামিলি কম দেখছি!
মলিন মুখে নিরঞ্জন জানালো, কীভাবে খিদিরপুর ডক থেকে ছটা উদ্বাস্তু পরিবার চুপিসারে পালিয়ে গেছে। তখন হাতে এমন সময় ছিল না যে নতুন করে কোনও ক্যাম্প থেকে নতুন ছয় ফ্যামিলি জোগাড় করে আনে।
বিশ্বজিৎকে চিন্তিত দেখায়। বললেন, জাঙ্গল রিক্লেম হয়ে গেছে। গভর্নমেন্ট জমি ফেলে রাখতে চাইবে না। মোপলাদের নিয়ে আসবে। এখন উপায়?
কী উত্তর দিতে গিয়ে আচমকা চোখেমুখে বিদ্যুৎ খেলে গেল নিরঞ্জনের। দ্যান তো লিস্টিহান বিশ্বজিতের হাত থেকে তালিকাটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পেন দিয়ে পটাপট কটা উদ্বাস্তুর নামের পাশে টিক মারতে মারতে প্রবল উত্তেজনার সুরে সে বলল, রাহাদা, আমার মাথায় একহান প্ল্যান আইছে। যদি আপনেরা হেল্প করেন, ছয়টা ডি পি ফেমিলির সমস্যা সৎ অইয়া যাইব।
হতবাক বিশ্বজিৎ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে সৎ করবে?
টেবলের ওপর হাতের তালিকাটা নামিয়ে রেখে বিশ্বজিৎ টিকমারা নামগুলো দেখিয়ে দেয়। সবসুদ্ধ বারোটা নাম। সেগুলোর পাশে বয়সও লেখা আছে। হরিপদ বিশ্বাস (২৪ বছর), জবা ভক্ত (১৬ বছর), গণেশ রুদ্রপাল (২১ বছর), ময়না দাস (১৭ বছর), গোপাল সূত্রধর (২৩ বছর ৬ মাস), সাগরী পাল (১৫ বছর), মাখন কর্মকার (২৬ বছর ৩ মাস), মিনতি দাস (১৫ বছর ৯ মাস), গগন বিশ্বাস (২০ বছর ১০ মাস), সুন্দরী কর্মকার (১৮ বছর), কার্তিক দাস (২২ বছর ৪ মাস), বাসমতী বিশ্বাস (১৯ বছর)।
নামগুলো দেখা হলে বিশ্বজিৎ মুখ তোলেন। নিরঞ্জন বলে, কিছু নি বুঝতে পারলেন?
বিশ্বজিৎকে কেমন যেন বিমূঢ় দেখায়। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, নো। নাথিং
বিনয় পাশে বসে ছিল। এই বারোটা নাম কোন পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করবে, সেটা তার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না।
নিরঞ্জন এবার জলবৎ বুঝিয়ে দিল। এই ছজোড়া যুবক-যুবতী সবাই অবিবাহিত, ওদের নিজস্ব কোনও ফ্যামিলি নেই। ওরা এসেছে ওদের মা-বাবার সঙ্গে, কেউ বা দাদা-বউদির সঙ্গে। এদের যদি এখনই বিয়ে দেওয়া যায়, ছটা নতুন ফ্যামিলি বানিয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। চুরানব্বই আর ছয় মিলিয়ে যোগফল পুরো এক শ। পাক্কা এক শ ছাব্বিশ বিঘে জমি বাঙালিদের হাতছাড়া হবে না।
উৎসাহে বিশ্বজিতের চোখমুখ ঝকমক করতে থাকে। বললেন, তোমার ব্রেনখানা সোনা দিয়ে বাঁধানো। হাত মিলাও ভাই নিজেই নিরঞ্জনের একখানা হাত তুলে নিয়ে ঝাঁকাতে লাগলেন, এ বিয়ে হবে, নিশ্চয়ই হবে। কে, কখন, কাকে বিয়ে করে সেপারেট ফ্যামিলি বানাচ্ছে, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এক শ ফ্যামিলি দরকার। সেটা পেলেই হল। তবে
নিরঞ্জন জিজ্ঞেস করে, তবে কী?
সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, ডাঃ চট্টরাজদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। যদি কিছু গোলমাল হয় ওঁরা সামলে নেবেন।
অন্য একটা ছাতার তলায় বসে সেনসাহেবরা বিশ্রাম করছিলেন। বিশ্বজিৎ উঠে গিয়ে তাদের ডেকে এনে নিরঞ্জনের পরিকল্পনার কথা জানাতে প্রথমটা সবাই থ। তারপর তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লেন।
সেনসাহেব বললেন, গ্র্যাণ্ড–
মণ্ডলসাহেব বললেন, ওদের বিয়ের বয়েস হয়েছে। কদিন পরে তো বিয়ে করবেই। কদিন আগেই না হয় করল। একটু থেমে বললেন, যখন হোক সেপারেট ফ্যামিলি তো ওদের হবেই। রস আইল্যান্ডেই না হয় শুভ কাজটা হল।
ডাক্তার চট্টরাজ সংশয়ের সুরে বললেন, এই সবে ওরা আন্দামানে পৌঁছেছে। এখনও নিজেদের কলোনিতে যায়নি। বিয়ে করতে কি রাজি হবে?
অইব স্যার, অইব। এই ব্যাপারখান আমার হাতে ছাইড়া দ্যান লাফ দিয়ে উঠে গার্ডেন আমব্রেলার বাইরে গিয়ে দুই হাত চোঙার মতো মুখের কাছে তুলে নিরঞ্জন হাঁকতে থাকে, হরিপদ বিশ্বাস-হরিপদ বিশ্বাস–এইহানে আসো