কথায় কথায় জানা গেল, উত্তর কলকাতার এই পুরানো, বয়স্ক বাড়িটায় সবসুদ্ধ পনেরোটি ভাড়াটে পরিবারের বাস। পরিবার পিছু আড়াই খানা করে ঘর, এক ফালি রান্নার জায়গা আর সামনের দিকের বারান্দার একটা অংশ। সবার সমান ভাড়া। মাসে সাঁইত্রিশ টাকা। বাড়িওলা এ বাড়িতে থাকে না। বেলেঘাটায় তার আরও একটা বাড়ি আছে, সেখানেই থাকে, আর মাসের পাঁচ তারিখে একবার এসে এখানকার ভাড়া আদায় করে নিয়ে যায়। যুদ্ধের আগে থেকে এ-বাড়িতে আছে বিমল। তার এক ছেলে, এক মেয়ে।
রামরতনের স্ত্রী আরও জানান, বিমলের শ্বশুরদের আদি বাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। যুদ্ধের ঠিক পরে পরে দেশের পাট চুকিয়ে শ্বশুর সখের বাজারে বাড়ি করেছেন। বুদ্ধিমান মানুষ। অত্যন্ত দূরদর্শী। তখনই আঁচ করেছিলেন, ভবিষ্যতে কলকাতা ছাড়া গতি নেই। সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন তিনি।
বিমলদের এই ভাড়াটে বাড়ি বা তার শ্বশুর সম্পর্কে বৃদ্ধা কেন যে সাতকাহন করে এত কথা বলছেন, বোঝা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই এ-সব শোনাবার জন্য তারা বিনয়ের জন্য প্রতীক্ষা করে ছিলেন না।
ছায়া আর মায়া চা এবং একটা প্লেটে খুব সস্তা বেকারির খানকতক নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসেছিল। বিনয় শুধু চায়ের কাপটাই তুলে নিল।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, পাকিস্থান থিকা আইনের সময় কইছিলা, তুমার দুই বইন আর বাবা কইলকাতায় আছেন। কার কাছে উঠছ?
এ-শহরে আসার পর যা ঘটে গেছে, সে-সব বাদ দিয়ে সংক্ষেপে বিনয় শুধু বলল, ছোটদির বাড়িতে আছি।
বাবা থাকতে বোনের কাছে কেন থাকে, এ-নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না বৃদ্ধা। বললেন, চাকরি বাকরি কিছু পাইছ?
বিনয় জানায়, খবরের কাগজে ছোটখাটো একটা কাজ জুটেছে।
রামরতনের স্ত্রী বললেন, ভাল, খুব ভাল। বউমা ক্যামন আছে?
আফজল হোসেন থেকে হরিন্দ কেঁড়াদার, এবং আরও অনেকেই ধরে নিয়েছে ঝিনুক তার স্ত্রী। রামরতনরাও হুবহু তাই ভেবেছেন। অনাত্মীয় অবিবাহিত এক তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে কোনও যুবক যে একা একা চলে আসতে পারে, এমনটা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। ঝিনুকের প্রসঙ্গ যে উঠতে পারে, এখানে আসার আগে ঘুণাক্ষরেও তার মাথায় আসেনি।
ধাক্কাটা সামলাতে খানিক সময় লাগল বিনয়ের। সবার ধারণায় স্থির হয়ে যেটা বসে গেছে, এখন আর তা অস্বীকার করা যায় না। তাই বলা গেল না ঝিনুক তার স্ত্রী নয়। এমনকি ঝিনুক যে চিরকালের মতো নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, তাও জানাতে পারল না বিনয়। ঝাপসা গলায় শুধু বলল, ভালই আছে
একটু চুপচাপ।
তারপর অনুযোগের সুরে রামরতনের স্ত্রী বললেন, তুমার পথ চাইয়া থাইকা থাইকা এক সোময় মনে হইছিল, আমাগো কথা বুঝিন ভুইলাই গ্যাছ। এই জীবনে আর দেখা হইব না। অথচ তুমারে আমাগো যে কত দরকার।
লহমায় বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলী সজাগ হয়ে উঠল। এতক্ষণ যা চলছিল সেগুলো নেহাতই কথার কথা। অনাবশ্যক। অসংলগ্ন। এবার আসল প্রসঙ্গটা উঠবে। বাসন্তী তার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিল। দরকারের কথা সেও বলেছে।
হাত থেকে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সোজাসুজি রামরতনের স্ত্রীর দিকে তাকায় বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, বড় ভাল দিনে আইছ। বিমল কি হের (তার) বউ বাড়ি থাকলে পরান খুইলা কথা কইতে পারতাম না।
বিনয় চকিত হয়ে ওঠে। রামরতুনের স্ত্রী কী এমন বলতে চান যা তার ঘনিষ্ঠ পরিজনদের সামনে বলা অসম্ভব?
বৃদ্ধা থামেননি, তুমার মনখান যে কত বড়, মানুষখান যে তুমি ক্যামন, দ্যাশ থিকা আইনের সোময় বুঝতে পারছি। তুমাগো নিজেগোই কত বিপদ, তবু হের (তার) মইদ্যে আমাগো দুই ডানা (ডানা) দিয়া আগলাইয়া পাকিস্থান থিকা ইন্ডিয়ায় লইয়া আইছ। নিজের চৌখে তো দেখছি তুমার মাউসা (মেসো) মশয়রে বাঁচানের লেইগা কী চ্যাষ্টা, কী যত্নই না করছ, আপন জনেরাও হেয়া (তা) করে না।
বিব্রত মুখে বিনয় বলে, এ-সব বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না। মানুষের জন্যে মানুষ এটুকু করেই।
বৃদ্ধা জোরে জোরে মাথা নাড়ালেন, কেও করে না বাবা। এক দেখলাম নাসেররে। হ্যায় (সে) পাশে না খাইলে ছায়া আর মায়ারে কি রক্ষা করতে পারতাম? রাইক্ষসেরা অগো (ওদের) কাইড়া লইয়া যাইত। হ্যায় কয়জন জুয়ান পোলারে লইয়া পরি (পাহারা) দিয়া দিয়া তারপাশায় আইনা গোয়ালন্দর ইস্টিমারে তুইলা দিল। নাসেরের পর দেখলাম তুমারে। আমাগো লেইগা কী না করছ! তুমরা দুইজন হইলা সত্যকারের মানুষ। একটু থেমে ফের শুরু করলেন, পাকিস্থান হওনের পর তুমাগো লাখান আমন আর কেওরে দেখলাম না।
সামনাসামনি বসে একটানা প্রশংসা শুনতে শুনতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল বিনয়ের। তারই মধ্যে ভাবছিল বৃদ্ধার এত গুণগানের পেছনে গভীর কোনও উদ্দেশ্য আছে।
রামরতনের স্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, বিমল কিছুক্ষণের মইদ্যে র্যাশন বাজার সাইরা ফিরা আসব। হের (তার) আগেই কথাখান সাইরা লই।
উত্তর না দিয়ে তাকিয়েই থাকে বিনয়।
বৃদ্ধা বলতে লাগলেন, মাইয়াগো লইয়া এই বাড়িতে আমরা বড় অশান্তিতে আছি বাবা। পাকিস্থান থিকা আইনের পর বিমলরা খুব যত্ন করত। সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকত। তুমার মাউসামশয়ের ছাদ্ধশান্তি ভাল কইরাই করছে। পাঁচজন বামন, শ্মশানবন্ধু আর এই বাড়ির ভাড়াইটাগো পাকা ফলার খাওয়াইছে। কিন্তুক হের পরই অগো, বিশেষ কইরা বিমলের বউ দীপ্তির মতিগতি বদলাইয়া গেল। আমাগো লগে ভাল কইরা কথা কয় না, দিনরাইত মুখ ভার। নিজের মনে গজর গজর করে। আমরা য্যান বোঝা হইয়া অগো কান্ধে চাপছি।