জাহাজে ওঠার আগে আন্দামানের মানচিত্রটা যে কতবার দেখেছে বিনয় তার লেখাজোখা নেই। দেখতে দেখতে সেটা তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে ঢুকে গেছে। সে আঁচ করে নিল রস-এর সামনের উপসাগরটা সোসসাস্ট্রেস বে। সেটা কতখানি চওড়া হবে? খুব বেশি হলে আধ মাইল। তার ওপারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পোর্টব্লেয়ার শহর। কোনাকুনি তাকাতেই একটা উঁচু টিলার মাথায় লালরঙের সুবিশাল ইমারতটা চিনতে লেশমাত্র অসুবিধে হল না। কুখ্যাত সেলুলার জেল। এই কারাগারের ছবি নানা বইয়ে কতবার যে দেখেছে! বিনয় নিজের অজান্তে অদ্ভুত শিহরন অনুভব করে।
এদিকে জাহাজ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে তুমুল ব্যস্ততা। খালাসিরা জাহাজের ওপর থেকে হইহই করে লম্বা সিঁড়ি নামাচ্ছে। পুনর্বাসন বিভাগের কর্মী এবং উদ্বাস্তুরা এখানে নামবে, তারই তোড়জোড় চলছে।
ডেক চেয়ার থেকে উঠে এল বিনয়। সোজা তার কেবিনে গিয়ে নিজের সুটকেস আর হোল্ড-অলটা নিয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ল নিরঞ্জনরা তাড়া দিয়ে দিয়ে জাহাজের খোল থেকে উদ্বাস্তুদের বার করে আনছে। পুরুষদের মাথায় এবং হাতে টিনের বাক্স, বোঁচকা বুচকি। বয়স্ক মেয়েমানুষগুলোর কাঁখে কাচ্চাবাচ্চা।
নিরঞ্জন আর বিভাস একটানা হেঁকে যাচ্ছিল, আপনেরা আস্তে আস্তে লাইন দিয়া নিচে নাইমা যান- অবিকল এই কায়দায় খিদিরপুর ডকে তারা শরণার্থীদের জাহাজে তুলেছিল।
উদ্বাস্তুরা কিন্তু ভীষণ চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে।
জবর ক্ষুদা বাবুরা। প্যাট জ্বলতে আছে– কিংবা কখন খাতি দেবান বাবারা? খিদির চোটে মরে যাতিচি
আসলে জাহাজে ওঠার পর একটা রাত কাটতে না কাটতেই সাইক্লোন ধেয়ে এল। তার ধাক্কা সামাল দিতে না দিতে শুরু হল সি-সিকনেস। এই কদিন উদ্বাস্তুরা যা খেয়েছে, তক্ষুনি বমি হয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন পেটে তাদের দাবানল জ্বলছে।
নিরঞ্জন বলল, আপনেগো ভাত তরকারি মাছ ডাইল রেডি কইরা রাখা আছে। নিচে নামলেই খাইতে বহাইয়া দিমু।
লোয়ার ডেক থেকে সমস্ত কিছু দেখতে পাচ্ছে বিনয়। দ্বীপে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা সবাই জাহাজের সিঁড়ির কাছে চলে এসেছেন। চেহারা এবং পোশাক আশাক দেখে আঁচ করা যায়, এঁরা উঁচু স্তরের অফিসার এবং অন্যান্য গণ্যমান্য লোক। চল্লিশ পঞ্চাশজন উদ্বাস্তু নামলেই তারা হাসিমুখে, আন্তরিক সুরে বলছিলেন, আসুন আসনুউদ্বাস্তুদের সঙ্গে করে ওঁরা তেরপলের ছাউনিগুলোর তলায় নিয়ে বসাচ্ছেন।
উদ্বাস্তুদের নামাতে নামাতে বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল নিরঞ্জন। হাত তুলে ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলল সে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে সব উদ্বাস্তু নেমে গেল। সবার শেষে নামল নিরঞ্জন, বিভাস, বিনয় এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের খালাসিরা সিঁড়ি টেনে তুলে ফেলল। তারপর গম্ভীর ভো বাজিয়ে বাকি প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে এস এস মহারাজা ঢিমে চালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। খুব সম্ভব ওধারেই কোথাও চ্যাথাম হারবার।
জাহাজ থেকে নেমে নিরঞ্জন বিনয়কে বলল, আপনে তো রাহাদার লেইগা অস্থির অইয়া আছেন। আহেন, আলাপ করাইয়া দেই- আন্দামানের সব অফিসার, ব্যবসাদার এবং নানা প্রোফেশনের লোকজন যেখানে ভিড় করে আছেন, বিনয়কে সেখানে নিয়ে গেল নিরঞ্জন। বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিল। বয়স বেশি নয়, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ। বেশ সুপুরুষ, সপ্রতিভ। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে।
বিশ্বজিৎ বললেন, জগদীশকাকার টেলিগ্রাম আমি পেয়েছি। আপনার সম্বন্ধে সব জানিয়ে দিয়েছেন। পোর্ট ব্লেয়ারে আপনি আমার কাছে থাকবেন। উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তো বটেই, আন্দামানের যে-কোনও বিষয়ে যা যা সাহায্য দরকার, সব পাবেন।
প্রথম আলাপেই মানুষটিকে খুব ভাল লেগে গেল বিনয়ের। মনে হল, বেশ কাজের লোক, তা ছাড়া ভারি অমায়িক এবং সহৃদয়। বিনয় বলল, অনেক ধন্যবাদ
বিশ্বজিৎ বিব্রতভাবে বললেন, ধন্যবাদ টন্যবাদ বললে লজ্জা পাব। নো ফর্মালিটি প্লিজ– বলে তিনিও কয়েকজনের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন, ইত্যাদি। এঁরা প্রবীণ মানুষ, পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স। সকলেই কথায়বার্তায় চমৎকার। এত উঁচু উঁচু পোস্টে আছেন, কিন্তু এতটুকু অহমিকা নেই। তারা জানালেন, কলকাতা থেকে আসা তরুণ সাংবাদিকটির সঙ্গে সমস্ত রকম সহযোগিতা করবেন।
ওধারে তেরপলের চাদোয়াগুলোর তলায় সব উদ্বাস্তুদের নিয়ে বসানো হয়েছিল। তাদের চেঁচামেচি আরও বেড়ে গেছে।
খাতি দ্যান বাবারা, তরাতরি খাতি দ্যান।
বিশ্বজিৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল নিরঞ্জন। তাকে বললেন, ড্রাম বোঝাই করে জল এনে রাখা হয়েছে। রিফিউজিদের বলো, যেন চটপট হাতমুখ ধুয়ে নেয়। তারপর খেতে বসিয়ে দাও–
দ্রুত চোখেমুখে জল ছিটিয়ে শরণার্থীরা কাতার দিয়ে বসে গেল। শালপাতার থালায় তাদের ভাত ডাল মাছ পরিবেশন করতে লাগল পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা। এদের সঙ্গে হাত মেলালেন সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, রাহাসাহেব, ডাক্তার চট্টরাজের মতো হোমরা চোমরারা।
এত বড় বড় মাপের সব মানুষ যত্ন করে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। ফলে উদ্বাস্তুরা অভিভূত। উদ্দীপ্ত মুখে বলে, বাবারা, মনে ডর লইয়া কালাপানি আইছিলাম। ভাবি নাই আপনেগো লাখান মাইনষেগো কাছে পামু। অহন ভরসা পাইতে আছি।