জাহাজের তলায় ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ নিরঞ্জন বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। বিভাসকে নিচে পাঠিয়ে সে তার কাছে চলে এসেছে।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিনয় বলে, আপনি বললেন কিছুক্ষণের ভেতর আমরা আন্দামান পৌঁছে যাব। কিন্তু জল ছাড়া কোনও দিকে কিছুই তো চোখে পড়ছে না।
নিরঞ্জন হাত-ঘড়ি দেখে বলল, অহন সাড়ে সাতটা। নয়টার আগেই আন্দামানের কোস্ট দেখতে পাইবেন।
নিরঞ্জনের কথাই হয়তো ঠিক। সে তো প্রায়ই উদ্বাস্তু আনতে কলকাতায় পাড়ি দেয়। নিয়মিত এই রুটে যাতায়াতের কারণে প্রখর অনুমানশক্তিতে সে বলে দিতে পারে কোথায় কতদূরে রয়েছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, কিংবা কতক্ষণে তার দেখা পাওয়া যাবে।
নিরঞ্জন বলল, বিনয়বাবু, জাহাজ আন্দামানের দিকে যত আউগাইতাছে (এগুচ্ছে) ততই আমার দুশ্চিন্তাহান বাড়তে আছে।
বিনয় অবাক হল।–কীসের দুশ্চিন্তা?
আপনে তো জানেনই, খিদিরপুর ডক থিকা ছয়টা ডি পি ফেমিলি ভাইগা গ্যাছে।
হ্যাঁ। সে তো জানিই।
এক শ ফেমিলি লইয়া যাওনের কথা। বাকি ছয়টা মেক-আপ করুম ক্যামনে?
বিনয় বলল, পালিয়ে গেলে কী আর করা যাবে?
নিরঞ্জন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, কী আর করন যাইব! আপনে তো কইয়াই খালাস। একহান কথা। ভাইবা দ্যাখছেন?
বিনয় কোনও প্রশ্ন করে না। শুধু নিরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিরঞ্জন বলতে লাগল, এক-এক ফেমিলির একইশ বিঘা কইরা জমিন পাওনের কথা। হেইটা অইলে হিসাবটা কী খাড়াইল? ছয় ইনটু একইশ–এক শ ছাব্বিশ বিঘা চাষের জমিন হাত থিকা বাইর অইয়া যাইব। এতখানি জমিন সোজা কথা! একটু থেমে ফের বলে, আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন স্কিম ইস্ট ব্যাঙ্গলের রিফুজিগগা লেইগা। কিন্তুক কেও না গ্যালে তাগো জমিনে সরকার অন্য প্রভিন্সের মানুষ আইনা বাইতে পারে। হেইটা কিছুতেই মাইনা নিমু না। উই জমিনটা যাতে রিফিউজিগো হাতেই থাকে হের একটা ফিকির বাইর করতেই অইব।
কী ফিকির?
হেইটা অহনও ভাইবা উঠতে পারি নাই। আগে আন্দামানে যাই। স্যান (সেন) সাহেব, মণ্ডল সাহেব, ব্যানার্জি সাহেব, রাহাদা-এনাগো লগে পরামশ কইরা দেখি। তেনারা কী কন হুনি। হের পর একটা ব্যবস্থা অইয়াই যাইব।
নিরঞ্জনের রাহাদা যে বিশ্বজিৎ রাহা সেটা আগেই জেনে নিয়েছে বিনয়। বিশ্বজিৎ আবার জগদীশ গুহঠাকুরতার বন্ধুর ছেলে। বিনয় যে আন্দামানে যাচ্ছে, টেলিগ্রাম করে জগদীশ বন্ধুপুত্রকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া বিনয়ের সঙ্গে একটা পরিচয়-পত্রও লিখে দিয়েছেন।
বিনয় বলল, আন্দামানে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্বজিৎবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে। দেবেন।
মনে আছে, মনে আছে। চিন্তা কইরেন না। ভরসা দেবার ভঙ্গিতে হাত তুলল নিরঞ্জন। জাহাজ থিকা রস আইল্যাণ্ডে নামনের লগে লগে রাহাদারে পাইয়া যাইবেন।
উনি রস আইল্যাণ্ডে আসবেন? বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করে বিনয়।
নিরঞ্জন বলল, হুদা (শুধু) রাহাদা ক্যান, আন্দামানের ব্যাঙ্গলি সোসাইটির যত ক্রিম–য্যামন ধরেন হারবার মাস্টার স্যান সাহেব, চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট মণ্ডলসাহেব, চিফ ম্যাডিক্যাল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ–এই হগল বাছা বাছা মাইনষেরা যেইদিন রিফুজি আহে, রস আইল্যাণ্ড যাইবেনই। হেরা ছাড়া নানান ডিপার্টমেন্টের ছোট বড় অফিসারেরা, কেরানিরা, দোকানদার, ব্যবসাদাররা তো থাকেই। য্যান মেলা বইয়া যায়
এত লোক যায় কেন?
রিফুজিগো রিসিভ করতে। আন্দামানে এত বাঙ্গালি দেইখা উদ্বাস্তুরা বল-ভরসা পায়।
এই খবরটা জানা ছিল না বিনয়ের। শুনে খুব ভাল লাগল। আন্দামানের মাটিতে পা দিয়েই উদ্বাস্তুরা বুঝতে পারবে নির্জন দ্বীপে তাদের চির-নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। স্বচক্ষে দেখতে পাবে এখানে তাদের অজস্র শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে।
খানিক নীরবতা।
তারপর নিরঞ্জন বলে, আপনে এইহানে বহেন। আমি গিয়া দেখি রিফুজিরা কী করতে আছে—
বিনয় বলল, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।
না না, এই কয়দিন আমাগো লগে হাত মিলাইয়া রিফুজিগো ম্যালা স্যবা (সেবা) করছেন। এই পরথম এই দিকে আইলেন। এটু পরেই আন্দামানের আইল্যাণ্ডগুলান দেখতে পাইবেন। বিউটিফুল সিনারি। দেখতে দেখতে চামড় হইয়া যাইবেন।
বিনয়কে ডেকে রেখে নিরঞ্জন চলে গেল। এদিকে লোয়ার ডেকের অন্য প্যাসেঞ্জারদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারা একে একে এসে বিনয়ের চারপাশের ডেক চেয়ারগুলোতে বসে পড়েছে।
.
আরও ঘণ্টাখানেক বাদে দূর দিগন্তে জলে সবুজ রঙের টুকরো টুকরো ঝাপসা কিছু ছবি ফুটে উঠল। ক্রমশ সেগুলো স্পষ্ট হতে হতে লম্বা গোলাকার তেকোনো চারকোনা নানা আকারের দ্বীপ হয়ে গেল। প্রতিটি দ্বীপ ঘন জঙ্গলে বোঝাই। শুধু গাছ আর গাছ। সেগুলোর যে-দিকটা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সেখানে ঠাসা ম্যানগ্রোভের ঝাড়। বিনয় ম্যানগ্রোভ আগেও দেখেছে। কিন্তু অন্য গাছগুলো একেবারেই অচেনা। দেখে মনে হল, এইসব দ্বীপে মানুষজন নেই। থাকলেও বনভূমির গভীর অন্তঃপুরে কোথায় রয়েছে, কে জানে। তবে অজস্র পাখি চোখে পড়ছে।
ডাইনে বাঁয়ে কাছে দূরে–অগুনতি দ্বীপের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে এক সময় এস এস মহারাজা একটা মাঝারি দ্বীপের গায়ে এসে ভিড়ল। বিনয় আন্দাজ করল, এটাই রস আইল্যাণ্ড। দ্বীপটা অজস্র নারকেল গাছে ছয়লাপ। ঘাসে-ভরা সবুজ সমতল জমিও রয়েছে। আছে বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই। দ্বীপটার গায়ে দুটো স্টিম লঞ্চ আর একটা মোটর বোট নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে এখন প্রচুর লোকজন। অনেকগুলো বিরাট বিরাট লাল-নীল ছাতা দেখা যাচ্ছে। গার্ডে আমব্রেলা। লম্বা লম্বা তেরপলের বেশ কটা ছাউনিও খাটানো রয়েছে।