খবরের কাগজে চাকরি নেবার পর থেকে ভোরে ওঠাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বিনয়ের। আন্দামানের জাহাজেও তার হেরফের ঘটেনি।
আজ সুর্যোদয়ের আগেই মুখটুখ ধুয়ে লোয়ার ডেকের সামনের দিকে একটা ডেকচেয়ারে বসে আছে সে।
ভোরের দিকটায় বছরের এ-সময় বঙ্গোপসাগরে মিহি সিল্কের মতো অল্প অল্প কুয়াশা থাকে। তবে সেটা নজর আটকে দেবার মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার আবরণ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। কদিন ধরে তাই দেখছে সে।
লোয়ার ডেকের এই ফাঁকা জায়গাটায় একাই রয়েছে বিনয়। জাহাজের লস্কর, স্টোকার, ইঞ্জিন অপারেটর–এরা ছাড়া এখনও কারও ঘুম ভাঙেনি। এমনকি সদাব্যস্ত, সারাক্ষণ তৎপর নিরঞ্জন এবং বিভাসও তাদের কেবিনে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
বিনয়ের চোখের সামনে যতদূর চোখ যায়, সেই দিগন্ত অবধি, বিপুল জলরাশি। কোথাও এতটুকু মারমুখী ভাব নেই। সমুদ্র জুড়ে শুধু অপার প্রশান্তি। কে বলবে, এই বঙ্গোপসাগর কদিন আগে কী তাণ্ডবটাই না ঘটিয়ে দিয়েছিল!
এস এস মহারাজা এগিয়ে চলেছে দূরন্ত গতিতে। ইঞ্জিনের ধকধকানি আর বিশাল বিশাল চাকার অবিশ্রান্ত জল কাটার আওয়াজ ছাড়া চরাচরের কোথাও কোনও শব্দ নেই।
জাহাজের যাত্রীরা না জাগুক, পাখিদের কিন্তু এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেছে। এক ঝাক সি-গাল মহারাজা জাহাজের দুপাশে চক্কর দিতে দিতে চলেছে। আরও দূরে আকাশে উড়ছে অগুনতি পাখি। ওরাও কি সি-গাল? বিনয় বুঝতে পারল না।
কলকাতায় থাকতেই বিনয় শুনেছিল, এস এস মহারাজা চারদিনে তাদের আন্দামানে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আচমকা সাইক্লোনে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছনো সম্ভব নয়। একটা দিন বেশি লাগবে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এর ভেতর আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতীয়। নাম ক্যাপ্টেন ওয়াই এস আইয়ার। দেরির কারণটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাইক্লোনে যখন সমুদ্র জুড়ে বিরাট বিরাট আকাশছোঁয়া ঢেউ ওঠে তখন মুখোমুখি যুঝতে যুঝতে, কখনও পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগুতে হয়। ঢেউ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে গেলে মহা সর্বনাশ। বিশাল আকারের তরঙ্গগুলি চকিতে জাহাজকে। উলটে দেবে। নিশ্চিত ভরাডুবি ঠেকানো যাবে না। সমুদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে সোজাসুজি আন্দামানের দিকে যেতে পারেনি এস এস মহারাজা। অনেকটা ঘুরপথে প্রায় বার্মার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। দুর্যোগ কাটলে পুরানো রুটে ফিরতে যথেষ্ট সময় লেগেছে।
কাল ক্যাপ্টেন জানিয়েছিলেন, আজ দুপুরের আগেই এস এস মহারাজা আন্দামানে পৌঁছে যাবে। নিরঞ্জনের কাছে জানা গিয়েছিল, জাহাজ প্রথমে ভিড়বে পোর্টব্লেয়ারের মুখোমুখি একটা ছোট্ট দ্বীপ-রস আইল্যাণ্ড। সেখানে উদ্বাস্তুদের নামিয়ে অন্য যাত্রীদের নিয়ে সেটা চলে যাবে চ্যাথাম হারবারে।
একটানা সমুদ্রযাত্রার পর ফি বারই শ্রান্ত শরণার্থীদের রস দ্বীপে নামানো হয়। সেখানে খাওয়া দাওয়া এবং বিশ্রামের পর তাদের পোর্টব্লেয়ারের আশেপাশে পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হয়।
পোর্ট ব্লেয়ার হল দক্ষিণ আন্দামানে। আন্দামান এবং নিকোবার আইল্যাণ্ডসের হেড কোয়ার্টার্স। এই শহরে চল্লিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এতদিন উদ্বাস্তুদের জন্য জনপদ তৈরির কাজ চলছিল। কিন্তু এবার মহারাজা জাহাজে যে ডি পি ফ্যামিলিগুলোকে আনা হয়েছে তাদের দুভাগে ভাগ করে একটা দলকে পাঠানো হবে অন্য এক দ্বীপে–মধ্য আন্দামানে। দক্ষিণ আন্দামানের মতো সেখানেও জঙ্গল কেটে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দুপুরের আগে আগেই এস এস মহারাজার আন্দামানে পৌঁছে যাবার কথা। কোন ছেলেবেলা থেকে এই রহস্যময় দ্বীপপুঞ্জের নানা ভয়াবহ কাহিনি শুনে আসছে বিনয়। সেখানে যেতে হবে, কোনওদিন সে কি কল্পনা করতে পেরেছিল? জাহাজ যত এগিয়ে যায়, তার হাড়ে-মজ্জায় প্রবল উত্তেজনা চারিয়ে যেতে থাকে।
একসময় দিগন্তের তলা থেকে সূর্য উঠে আসে। প্রথমে রক্তবর্ণ। তারপর দ্রুত রং পালটে যায়। লালটা আর লাল রইল না, ক্রমশ গনগনে আগুনের চেহারা নিতে থাকে। কুয়াশা আগেই ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছিল। রোদ তপ্ত হয়ে দিগন্তজোড়া নোনা জলের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। খানিক পরে আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। মনে হবে, জল ছুঁড়ে আগুনের হলকা উঠে আসছে।
নিরঞ্জনের গলা কানে এল, আপনে এইহানে? সমুন্দুরে সূর্যোদয় দেখতে আছিলেন? একটা চেয়ার টেনে এনে সে পাশে বসে পড়ল।
বিনয় একটু হাসল।–ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল। তখন সবাই ঘুমোচ্ছে। এক-একা কী আর করি। তাই এখানে এসে বসে আছি। বিভাসবাবু কোথায়? তাঁকে দেখছি না তো সেই যে শান্তিনিবাস মেসে নিরঞ্জন বিভাসকে নিয়ে এসেছিল, তারপর থেকে ওদের আলাদা আলাদা কখনও দেখা যায়নি। দমদমের ত্রাণশিবিরে, খিদিরপুর ডকে কিংবা জাহাজে, সর্বত্র দুজন ওরা একসঙ্গে কাজ করে গেছে। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে যেন ভাবা যায় না।
নিরঞ্জন জানায়, আজ তাদের ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। চটপট মুখটুখ ধুয়ে বিভাসকে নিয়ে দুজনে জাহাজের খোলে রিফউজিদের কাছে যাচ্ছিল। কেননা, উদ্বাস্তুদের তাড়া দিয়ে দিয়ে চান করাতে হবে, সকালের খাবার খাইয়ে রেডি করিয়ে রাখতে হবে। এ-সব করাতে দু-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণে জাহাজ আন্দামানে পৌঁছে যাবে। এস এস মহারাজা বেশিক্ষণ রস আইল্যাণ্ডে দাঁড়াবে না। উদ্বাস্তুদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে।