কাল রাতে খিদিরপুরে জাহাজের কেবিনে বিনয় যখন শুয়ে পড়ে, দুর্যোগের আভাসমাত্র ছিল না। মেঘশূন্য আকাশ ছিল আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ। সেখানে স্ফটিক খণ্ডের মতো তারাগুলি জ্বল জ্বল করছিল। ঘুম ভাঙার পর যাকে আলকাতরার কালো পোচ মনে হয়েছিল তা হল স্তরে স্তরে ঘন মেঘ। সেই মেঘ চিরে ফেড়ে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। বাজ পড়ছে মহুমূহু। কাল বাতাস বয়ে যাচ্ছিল ঝিরঝির করে। তার তেজ এখন কোটিগুণ বেড়ে গেছে। ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠেছে।
সুড়ঙ্গের মতো সেই পথ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে জাহাজের তলদেশে নামতে নামতে নিরঞ্জন জানায়, কাল মধ্য রাতে এস এস মহারাজা কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিল। সমুদ্রের মোহানা পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই চলে এসেছে। কিন্তু ভোর হতে না হতেই মেঘ জমতে শুরু করেছিল। বাতাসে দেখা দিয়েছিল খ্যাপামির লক্ষণ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের মাতামাতি বাড়তে লাগল।
নিরঞ্জন বলতে থাকে, এই হালার বে অফ ব্যাঙ্গল পাগলাচণ্ডী সমুন্দর। হের মতিগতি বুঝন ভার। কহন যে চেইতা (ক্ষিপ্ত হয়ে উঠব, কেও জানে না।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, এখন কি দিন, না রাত্তির?
দিন। দশটা সাড়ে-দশটা বাজে। ম্যাঘ কইরা আন্ধার হইছে বইলা দিন-রাইত ফারাক করা যায় না।
জাহাজের খোলে ঢুকে দেখা গেল হুলস্থুল কাণ্ড। উদ্বাস্তুরা উন্মাদের মতো কপাল কি বুক চাপড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। তাদের তুমুল আর্তনাদ সিলিং ভেদ করে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে কয়েকজনের চিৎকার শোনা গেল। গরমেন আমাগেরে মারতি নিয়া যাতিছে। আমাগের আর রক্ষে নেই– কথা শুনে আঁচ করা যায় খুলনা কি যশোর অঞ্চলের লোজন।
আর-একটি দল পাটাতনে উবু হয়ে বসে হাতজোড় করে সমস্বরে গেয়ে চলেছে, হরেকৃষ্ণ হরেরাম, হরেকৃষ্ণ হরেরাম। ভগমান আমাগো বাঁচাও
অন্য একটা দলের কয়েকজন মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ব্যাকুলভাবে বলে চলেছে, মা গঙ্গা, তুমার রোয় থামাও। আমাগো উপুর মুখ তুইলা তাকাও।
এদিকে বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডবও বেড়ে চলেছে। পাতালপুরীতে বসেও টের পাওয়া যাচ্ছে এক মাইল দুমাইল জুড়ে পর্বতপ্রমাণ এক-একটা ঢেউ বিশাল জলযানটাকে পলকে মোচার খোলার মত মহাশূন্যে তুলে নিয়ে পরক্ষণে আছড়ে নিচে নামিয়ে আনছে। জাহাজের পোর্টহোলগুলো জলের তলায়, তাই বাইরের কিছুই দেখা যচ্ছে না। তবু আঁচ করা যায়, ঝড় বইছে উদ্দাম গতিতে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে অঝোরে বৃষ্টি।
ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে চলছে রোলিং। জাহাজ কখনও ডাইনে হেলে পড়ছে, কখনও বাঁয়ে। কখনও সামনে, কখনও পেছনে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, এই বুঝি ডুবে যায়।
রেলিংয়ের ফল হয়েছে এই, প্রাণ বাঁচাতে যারা জাহাজের খোলে জড়ো হয়েছে তাদের অনেকেই হড়হড় করে বমি করে ফেলছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা। যে যা খেয়েছিল, পাকস্থলী তা ধরে রাখতে পারেনি। গলা দিয়ে ঠেলে সব বেরিয়ে এসেছে।
তাণ্ডব কমতে দুপুর পেরিয়ে গেল।
এখন আর উতরোল কান্না, চিৎকার বা অকূল প্রার্থনা, কিছুই শোনা যাচ্ছে না। উদ্বাস্তুরা বমিতে মাখামাখি হয়ে আচ্ছন্নের মতো এধারে ওধারে পড়ে আছে। উগ্র কটু গন্ধে ভরে গেছে জাহাজের খোল।
কিন্তু রোলিং বা সাইক্লোন কিছুই যেন ছুঁতে পারেনি নিরঞ্জন আর বিভাসকে। দুর্যোগ কেটে গেলে তারা ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। তারপর তাদের সহকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উদ্বাস্তুদের সারা গা ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে, ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিল।
রোলিংয়ে ভীষণ কাবু হয়ে পড়েছিল বিনয়। তবু নিরঞ্জনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোকে যতখানি পারল, শুশ্রূষা করল।
ফের যখন নিরঞ্জনদের সঙ্গে বিনয় ওপরের ডেকে উঠে এল, বিকেল হয়ে গেছে। সারা গায়ে বমি লেগে আছে। এখন তার প্রথম কাজটি হল ভাল করে চান। তারপর টানা একটি ঘুম।
.
৭৮.
দুর্যোগের পর তিনটে দিন কেটে গেছে। বঙ্গোপসাগর আচমকা যেমন খেপে উঠেছিল, আচমকাই তেমনি শান্ত হয়ে গেছে। এই সমুদ্রের মেজাজ একেবারেই সৃষ্টিছাড়া। নিরঞ্জন বলেছিল, কখন যে তার মাথায় পাগলচণ্ডী ভর করবে, আর কখন যে সে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসবে, আগেভাগে তার হদিস মেলে না। সাইক্লোনের সময় কয়েকটা ঘণ্টা বঙ্গোপসাগর চোখের পলকে মহারাজা জাহাজটাকে আঙুলের ডগায় তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আকাশে, পরক্ষণে নামিয়ে আনছিল পাতালে। একবার আকাশ, একবার রসাতল। মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের এই মারাত্মক খেলাটা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে।
প্রাণ বাঁচাতে যাদের জাহাজের খোলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের দুমড়ে মুচড়ে ঝাঁকিয়ে আর ক্রমাগত আছাড় মেরে মেরে সমুদ্র প্রায় সাবাড় করে এনেছিল। তবে সবচেয়ে কাবু হয়ে পড়েছিল উদ্বাস্তুরা। সাইক্লোনের পরও দুটো দিন ধন্দ-ধরা মানুষের মতো তারা হয় শুয়ে থেকেছে, নইলে ঝিম হয়ে বসে থেকেছে।
তবে কাল থেকে এই মানুষগুলো খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু কিছু খেলে পেটে রাখতে পারছে না। তক্ষুনি গলা দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সি-সিকনেস।
সাইক্লোনটা অবশ্য একদিক থেকে নিরঞ্জনদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। বিভাস দমদমের ক্যাম্পে গিয়ে আপেল আঙুর আর ডায়মণ্ডহারবারের পর থেকে চর পড়ার গল্প ফেঁদে এসেছিল, তাই নিয়ে উদ্বাস্তুরা নিশ্চয়ই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করে দিত। কিন্তু সামুদ্রিক ঝড় তাদের মাথা থেকে সে-সব বার করে দিয়েছে।