পুরো জমায়েতের চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েগুলোকে দেখল বিনয়। কিন্তু না, ঝিনুককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যে সামান্য সংশয় থেকে গিয়েছিল সেটাকে প্রায় উড়িয়েই দিল সে। ঝিনুক ঘোমটা টেনে বসে আছে তা ভাবাই যায় না। সে অসূর্যস্পশ্যা নয়।
বিনয়ের মনে হল, সে যে একটি মেয়ের মুখে ঝিনুকের আদল দেখেছিল সেটা তার নিজেরই চোখের ভ্ৰম, অস্থির মনের বিভ্রান্তি। সেই বিকেল থেকে যে প্রবল উৎকণ্ঠা তাকে ব্যাকুল করে রেখেছিল, এখন তার অবসান ঘটেছে।
ভিড়ের ভেতর ঝিনুককে খোঁজাখুজি করতে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। বিনয় নিরঞ্জনদের কাছে ফিরে এল।
এদিকে নিরঞ্জনদের তাড়ায় এখানকার সারি সারি চানঘরগুলো থেকে উদ্বাস্তুরা হাত-পা মুখটুখ ধুয়ে এসেছিল। বিছানাও পেতে ফেলেছে। বাঙ্কে যাদের জায়গা হয়নি তারা মেঝের পাটাতনে শোওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
এখন নিরঞ্জন আর বিভাসের অ্যাসিস্টান্টরা এবং জাহাজের কিচেনের লোকজন উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে বসিয়ে সিলভারের থালা-বাটিতে রাতের খাবার দিচ্ছে। ভাত, ডাল আর ডিমের ঝোল। পরে একটা করে পানতুয়া।
খাওয়াদাওয়া চুকতে নটা বেজে গেল।
নিরঞ্জন তার ত্রাণবিভাগের সহকারীদের বলল, তুমরা ডাইনিং হলে গিয়া অহনই খাইয়া আসো। তোমাগো খাওন হইলে আমরা উপুরে খাইতে যামু। তুমরা রিফুজগো লগে রাইতে এইহানে থাকবা। আমরা থাকুম লোয়ার ডেকের ক্যাবিনে। কিছু দরকার অইলে লগে লগে (তক্ষুনি) আমাগো খবর দিবা। এতগুলান মাইনষের বাঁচা-মরার দায়িত্ব আমাগো। হগল দিকে নজর রাখবা।
সহকারীরা খেয়ে এলে বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে নিরঞ্জন আর বিভাস খাবার ঘরে চলে গেল।
.
সেদিন দমদমের ত্রাণশিবিরগুলোতে যাবার পর থেকে মাঝখানের কটা দিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়নি বিনয়। জিনিসপত্র কেনাকাটা, গোছগাছ, দিদিদের বাড়ি যাওয়া, এমনি নানা ব্যাপারে প্রচুর ধকল গেছে। আজও খিদিরপুর ডকে এক লহমা বসে যে একটু জিরিয়ে নেবে, তেমন ফুরসত মেলেনি। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। ক্লান্তিতে সারা শরীর ভেঙে আসছে, ছিঁড়ে পড়ছে স্নায়ুমণ্ডলী। নিরঞ্জন আর বিভাসের হাল তার চেয়ে অনেক বেশি কাহিল। উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে চোখের সামনে রঙিন স্বপ্নের হাজারো ছবি টাঙিয়ে জাহাজে তোলা যে কী দুরূহ ব্যাপার, বিনয় তা ভাল করেই জানে। আন্দামানে গেলে অঢেল আরাম, অঢেল আনন্দ, অফুরান সুখ। এমনি কত কত রূপকথা যে নিরঞ্জনদের বানাতে হয়েছে।
খাওয়া সেরে নিরঞ্জন বিনয়কে বলল, শরীলে আর দিতে আছে না। অহন বিছানায় কাইত অইয়া পড়ন লাগে। আপনেও যান –
নিজের কেবিনে এসে ক্ষিপ্র হাতে উঁচু খাঁটিয়ায় বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে বিনয়। এস এস মহারাজা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। কখন সেটা ছাড়বে, কে জানে।
শোবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে আসতে থাকে বিনয়ের। তারই মধ্যে কাঁচের জানালা দিয়ে সে দেখতে পায়, আলোয় আলোয় খিদিরপুর ডক যেন আশ্চর্য এক ইন্দ্রপুরী।
.
৭৭.
ঘুমটা আচমকাই ভেঙে গেল পাঁচমেশালি আওয়াজে। বহু মানুষের ত্রস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আসছে দুদ্দাড় ছোটাছুটির শব্দ। তার মধ্যেই কারা যেন হিন্দিতে তাড়া দিয়ে চলেছে। সাইক্লোন আতি হ্যায়। সব কোঈ নিচা হোলমে চলা যাও। জলদি কর–সেই সঙ্গে দশ দিগন্ত কাঁপিয়ে গাঁ গাঁ অবিরল আওয়াজ। লক্ষ কোটি দানব যেন অবিরাম গজরে চলেছে। তাছাড়া উঠে আসছে প্রবল ধকধকানির মতো শব্দ। একটানা, বিরতিহীন।
ধড়মড় করে উঠে বসল বিনয়। শিয়রের দিকের জোড়া কাঁচের জানালা জাহাজের দেওয়ালের গায়ে আটকানো। তার বাইরে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায়, কেউ যেন ঘন আলকাতরার পোঁচ লাগিয়ে দিয়েছে। যে-বেডটায় সে বসে আছে সেটা প্রচণ্ড দুলছে।
প্রথমটা বিনয় খেয়াল করতে পারল না, এই মুহূর্তে সে কোথায় রয়েছে। নিজের অজান্তে তার মস্তিষ্কে স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে চিতা চলছিলই। চকিতে মনে পড়ে গেল এস এস মহারাজা জাহাজে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামান চলেছে। কিন্তু কাল রাতে শোবার সময় আলোকোজ্জ্বল খিদিরপুর ডক। চোখে পড়েছিল। এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। জানালার বাইরে শুধুই অন্ধকার।
এটা টের পাওয়া যাচ্ছে, বিশাল জলযান ঢেউ কেটে কেটে ছুটে চলেছে। সে যখন গভীর ঘুমে সেইসময় হয়তো জাহাজ রওনা হয়েছিল। একটানা ধকধকানি যেটা শোনা যাচ্ছে তা ইঞ্জিনের আওয়াজ। তাছাড়া জাহাজের বিশাল বিশাল চাকাগুলোর জল কাটার গম্ভীর ঘড়র ঘড়র আওয়াজটাও এখন বোঝা যাচ্ছে। এর সঙ্গে সাঁ সাঁ শব্দটা কীসের, আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
এখন কি রাত? কিন্তু আকাশে চাঁদ বা একটি নক্ষত্রও চোখে পড়ে না। জানালার বাইরে সমস্ত কিছুই আঁধারে বিলীন। সেদিকে দিশেহারার মতো তাকিয়ে কী করবে, বিনয় যখন ভাবছে, দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা পড়ল।
বিনয়বাবু-বিনয়বাবু
নিরঞ্জনের গলা। বেড থেকে লাফিয়ে নেমে এসে দরজা খুলে দেয় বিনয়।
নিরঞ্জন এস্তভাবে বলল, তরাতরি নিচে চলেন। সাইক্লোন অহনই আইয়া পড়ব
সাইক্লোনের কথাটা আগেও আবছাভাবে কানে এসেছে। কারা যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যাত্রীদের সতর্ক করে দিয়ে নিচে যেতে বলছিল।
কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে বিনয়। তক্ষুনি চোখে পড়ে আপার ডেক আর লোয়ার ডেকের আতঙ্কগ্রস্ত প্যাসেঞ্জাররা উদ্ভ্রান্তের মতো সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, জাহাজের নিচে যেখানে উদ্বাস্তুরা রয়েছে সেখানে নেমে যাচ্ছে।