.
এখন সাতটার মতো বাজে। গোটা জাহাজ জুড়ে সব আলো জ্বলে উঠেছে। আশেপাশে আরও কটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোতে তো বটেই, জেটিতে এবং ডকের যেখানে যতদূর চোখ যায়–শুধু আলো আর আলো।
কেবিনের টিকেট বিনয়ের। লোয়ার ডেকের একটা ছোট কেবিন তার জন্য রিজার্ভ করা হয়েছে। তার তিনটে কেবিন পর একটা মাঝারি কেবিন বিভাস আর নিরঞ্জনের।
মিনিট খানেক হল নিজের কেবিনে এসেছে বিনয়। বিভাস, নিরঞ্জন আর কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য কর্মচারীরা কেউ লোয়ার ডেকে আসেনি। সবাই উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আরও নিচে জাহাজের খোলে চলে গেছে।
বিনয়েরও ওদের সঙ্গে যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হাতে লটবহর ঝুলিয়ে যাওয়াটা ঝাটের ব্যাপার। জাহাজে উঠে আঙুল বাড়িয়ে তার কেবিনটা দেখিয়ে দিয়েছিল নিরঞ্জন। তাই নিজের কেবিনে চলে আসতে তার অসুবিধে হয়নি।
পৃথিবীর কোনও দিকেই এখন নজর নেই বিনয়ের। মাথার ভেতর অবিরল পাক খেয়ে চলেছে একটাই চিন্তা-ঝিনুক। চোখের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে একটাই ছবি–ঝিনুক। সুটকেস নামিয়ে, ত্বরিত হাতে হোল্ড-অলটা খাঁটিয়া ধরনের একটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
বিনয় এর মধ্যে জেনে গেছে, লোয়ার ডেকে বিশাল ইঞ্জিন রুমের পেছন দিকে একজোড়া গোলাকার সুড়ঙ্গ রয়েছে। ওই দুটো দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে জাহাজের খোলে। সুমদ্রযাত্রায় সেটাই উদ্বাস্তুদের আস্তানা।
বিনয় সিঁড়ি ভেঙে পাতালে নেমে এল। এখানে জাহাজের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি পুরু কাঠের পাটাতনে ঢাকা। একধারে উঁচু রেলিং-ঘেরা এলাকায় স্থূপাকার মালপত্র। বিকেলে জেটি থেকে কুলিদের এ-সব তুলে আনতে দেখেছিল সে। বাকি অংশটায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে শোওয়ার জন্য সারি সারি বাঙ্ক। একটার ওপর একটা। রেলের কামরায় যেমনটা দেখা যায়। বাঙ্ক ছাড়াও প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। সেখানে উদ্বাস্তুরা তাদের লটবহর নিয়ে ঠাসাঠাসি করে বসে ছিল। জেটিতে লোকগুলোর চোখেমুখে যেটুকুও চাঙ্গা ভাবা ছিল, জাহাজে ওঠার পর সেটাও বুঝি বা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিচু গলায় কথা বলছিল। তবে বেশির ভাগই ধন্দ-ধরা। বাচ্চাগুলো তাদের মায়েদের আঁকড়ে ধরে চুপচাপ হয়ে গেছে। আন্দামানে যাওয়াটা সমীচীন হল কি না, তারা যেন। বুঝে উঠতে পারছে না। তাদের ঘিরে অনিশ্চয়তা, ভয় এবং তীব্র দুর্ভাবনা।
এদিকে নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা অবিরাম উদ্বাস্তুদের সজীব রাখতে চাইছে।
নিরঞ্জন বলছিল, এই কি, আপনেরা একহানে দলা পাকাইয়া রইছেন ক্যান? হাত মুখ ধুইয়া লন। বাঙ্কে হগলের জাগা অইব না। নিচেও অনেকের হুইতে হইব। নেন, নেন, উইঠা, বিছানা পাইতা ছানের (চানের) ঘরে গিয়া হাতমুখ ধুইয়া লন। আটটায় রাইতের খাওন (খাবার) দেওয়া অইব।
বিভাস বলছে, অত মনমরা অইয়া থাকলে চলে? য্যান শ্মশানযাত্রী। আরে বাবা, আন্দামানে গ্যালে জমিন পাইবেন, নিজেগো বাড়িঘর হইব। কত বড় লাভ কন দেখি। মনে ফুর্তি আনেন। আনন্দ করেন
প্রথম থেকেই বিনয় দেখে আসছে পুনর্বাসন বিভাগের এই দুই যুবক, বিশেষ করে নিরঞ্জন শরণার্থীদের আন্দামানে নিয়ে যাবার ব্যাপারে উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটছে। যুগলের মুখটা নতুন করে মনে পড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের উৎখাত হয়ে আসা মানুষজনকে তুলে এনে বিপুল পরিশ্রমে আর অসীম যত্নে মুকুন্দপুরে নতুন এক পূর্ববঙ্গ সৃজন করে চলেছে সে। অবিকল তারই মতো নিরঞ্জনও চাইছে বঙ্গোপসাগরের সুদূর দ্বীপমালায় হাজার বছরের অরণ্য নির্মূল করে গড়ে তুলবে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূলদের জন্য নতুন বাসভূমি। পশ্চিম বাংলার বাইরে সমুদ্রের মাঝখানে আর-এক বাংলা। একান্তভাবেই বাঙালিদের জন্য। চকিতে নাড়া দিয়েই ভাবনাটা চকিতে মিলিয়ে গেল।
বিনয় পায়ে পায়ে উদ্বাস্তুদের দিকে এগিয়ে যায়। নিরঞ্জনরা তাকে দেখতে পেয়েছিল। জিজ্ঞেস করে, আইয়া পড়ছেন?
বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে। নিরঞ্জনরা আর কোনও প্রশ্ন না করে বিপুল উদ্যমে ফের ম্রিয়মাণ উদ্বাস্তুদের সজীব করে তুলতে থাকে।
হলধর কোত্থেকে যেন উঠে এসে বিনয়ের পাশে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত মুখ। বলে, ছুটোবাবু, এতক্ষণ কই আছিলেন? আপনেরে না দেইখা জবর ডরাইয়া গ্যাছিলাম
বিনয় বলল, আমার টিকেট ওপরের তলায়। সেখানে বাক্স-বিছানা রেখে এলাম। তাই একটু সময় লাগল–
ছুটোবাবু, আমাগো জাহাজের এই গাদে (গর্তে) হান্দাইয়া (ঢুকিয়ে) দিছে। ইন্দুরের লাখান ফান্দে আটকাইয়া থাকতে অইব। চাইর দিক বন্দ। দম বন্দ অইয়া হগলটি মরুম–
না– জোরে জোরে মাথা নাড়ে বিনয়। সিলিংয়ে পুরু টিনের তৈরি বিরাট বিরাট উইন্ড ব্লোয়ার। সেগুলো দেখিয়ে বলে, এখানে বাতাসের অভাব হবে না। ওগুলো দিয়ে সারাক্ষণ হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারও মারা যাবার ভয় নেই।
এর মধ্যে উদ্বাস্তুদের জটলা থেকে আরও কয়েকজন উঠে এসেছিল। তাদের সবাইকে কাছাকাছি একটা ব্লোয়ারের ভোলা মুখ দেখিয়ে বলল, ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। বুঝতে পারবেন, ওপর থেকে হাওয়া আসছে।
হলধররা ব্লোয়ারটার দিকে এগিয়ে যায়। বিনয় ওদের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিকই, কিন্তু তার নজর খানিক দূরের বাকি উদ্বাস্তুদের দিকে। সে সোজা সেখানে চলে যায়। পুরুষ এবং বাচ্চাকাচ্চাদের সম্বন্ধে তার লেশমাত্র আগ্রহ নেই। বিনয়ের একমাত্র লক্ষ্য-মেয়েদের মুখ। বেশির ভাগেরই মুখ খোলা। তবে বেশ কয়েকজনের ঠোঁট অবধি ঘোমটা টানা।