.
মেডিকেল চেক-আপ শেষ হতে হতে বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এল। ডকের সব বাতি জ্বালিয়ে। দেওয়া হয়েছে। জোরালো আলোর ঢল নেমেছে চারপাশে। ওদিকে অন্য প্যাসেঞ্জার এবং পর্বতপ্রমাণ। মালপত্র জাহাজে উঠে গিয়েছিল। এবার উদ্বাস্তুদের পালা। জেটিতে জাহাজের নিচে সিঁড়ির মুখে নামের তালিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিভাস, নিরঞ্জন, হিরন্ময় এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসার আর কর্মীরা। রয়েছে জাহাজ কোম্পানির লোকজন।
লিস্ট দেখে নাম ডেকে ডেকে উদ্বাস্তুদের জাহাজে তুলছে নিরঞ্জনরা। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে, কাঁধে মাথায় যার যার লটবহর চাপিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ছিন্নমূল মানুষগুলো নতুন আশ্রয়ের আশায় ওপরে উঠছে।
নিরঞ্জনদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছিল বিনয়। উদ্বাস্তুদের জাহাজে চড়াবার পর নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন বিভাগের অন্য কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে সেও ওপরে উঠবে। এর মধ্যে তার জানা হয়ে গেছে, আন্দামানে পৌঁছতে চারদিন লেগে যাবে। এতগুলো মানুষ যাচ্ছে। পথে সি-সিকনেস ছাড়াও নানারকম অসুখ বিসুখ হতে পারে, তাই একজন ডাক্তারও যাচ্ছেন।
সার বেঁধে উদ্বাস্তুরা উঠছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখে পড়ে একটি তরুণী সিঁড়ির প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে। তার মুখের ডান পাশটা দেখা যাচ্ছিল। মনে হয় ঝিনুকের আদল। হঠাৎ প্রবল আলোড়নে বুকের ভেতরটা উথালপাতাল হতে থাকে। সৌরজগৎ যেন প্রবল ঘূর্ণিপাকে দুরন্ত গতিতে ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। বিনয়ের শ্বাস আটকে আটকে আসে। সে যে সিঁড়ি টপকে টপকে মেয়েটির কাছে যাবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে সত্যিই সে ঝিনুক কি না, তার উপায় নেই। সিঁড়িটা সরু, সেখানে কাতার দিয়ে ধাপে ধাপে মানুষ। ওপরে যেতে হলে তাদের ধাক্কা মেরে, ঠেলে উঠতে হয়।
কয়েক লহমা মাত্র। জাহাজের আপার ডেকে উঠে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। স্তম্ভিত, হতবুদ্ধি বিনয় আচ্ছন্নের মতো জেটিতে দাঁড়িয়ে রইল। তার মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যেতে থাকে।
উদ্বাস্তুরা জাহাজে উঠে পড়েছিল। আচমকা-উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠে নিরঞ্জন, সব্বনাশ হইয়া গ্যাছে। ছয়টা ডি পি ফেমিলি মিসিং। নিঘাত চৌখে ধূলা দিয়া জেটি থিকা ভাইগা পড়ছে। অহন আমি কী করুম? সোময়ও তো নাই যে অন্য কুনোখান থিকা ছয়টা ফেমিলি ধইরা আইনা কোটা পূরণ করি। ছয়টা বাঙ্গালি ফেমিলি না গ্যালে সরকার ছয়টা মোপলা ফেমিলিরে আন্দামানে পাঠাইয়া দিতে পারে। ব্যাঙ্গলের যে কতখানি ক্ষতি হইয়া যাইব? একটানা তার আক্ষেপ চলতেই থাকে।
তার কথার উত্তরে হিরন্ময়রা কিছু বলছিলেন, কিন্তু সে-সব শুনতে পাচ্ছিল না বিনয়। সেই মেয়েটির মুখের আধখানা তার চোখের সামনে স্থির চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখন একটাই চিন্তা, জাহাজে ওঠার পর তাকে খুঁজে বার করতেই হবে।
৭৬-শেষ. অজস্র মালপত্র
৭৬.
এস এস মহারাজায় নানা ধরনের অজস্র মালপত্র বিকেলে তুলে ফেলা হয়েছিল। তারপর সাধারণ যাত্রী এবং উদ্বাস্তুরা উঠেছে। সবার শেষে উঠেছে বিভাস, নিরঞ্জন, বিনয় এবং কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন বিভাগের আরও কয়েকজন কর্মচারী, একজন ডাক্তার, একজন নার্স। হিরন্ময়রা, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা কিছুক্ষণের জন্য জাহাজে উঠে উদ্বাস্তুদের। অঢেল ভরসা, প্রচুর আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিয়েছেন। আন্দামানে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এবং এখানকার সরকার সবসময় শরণার্থীদের পাশে থাকবে। শত শত ছিন্নমূল মানুষের স্থান তাদের হৃদয়ে। দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে তারা যদি কোনওরকম অসুবিধে বা বিপদ আপদে পড়ে, খবর পাওয়ামাত্র হিরন্ময়রা দৌড়ে যাবেন। তৎক্ষণাৎ তাদের সমস্ত সমস্যার সুরাহা করে আসবেন। চোখের আড়ালে গেলেই যে পশ্চিমবঙ্গবাসীরা তাদের ভুলে যাবে, এমন চিন্তা কেউ যেন মাথায় না আনে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
হিরন্ময় নেমে যাবার পর জাহাজের সিঁড়ি তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন কেউ আর উঠতে বা নামতে পারবে না।
মহারাজার লোয়ার ডেকের তলায়, অর্থাৎ জাহাজের খোলের ভেতর চুরানব্বইটা ডি পি ফ্যামিলির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা মেয়েপুরুষ নিয়ে মোট চার শ বিরাশি জন। লোয়ার ডেকের দুধারে পয়সাওলা প্যাসেঞ্জার এবং উঁচু পোস্টের সরকারি বে-সরকারি অফিসারদের জন্য বেশ কটা কেবিন। বাকি প্যাসেঞ্জাররা–যাদের অল্প দামের টিকেট তারা থাকবে ডেকে। লোয়ার ডেকের মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্জিন-ঘর। ধোঁয়া বার করে দেবার জন্য গোলাকার বিশাল চিমনি সোজা ওপর দিকে উঠে গেছে। চিমনির সামনে খানিকটা এলাকা খোলা। সেখানে অগুনতি ডেক চেয়ার পাতা। দীর্ঘ সুমদ্রযাত্রায় যাত্রীরা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কখনও কখনও সময় কাটায়। জাহাজের দুই প্রান্ত বুক-সমান হাইটের মজবুত লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এই ডেকেরই পেছন দিকের অনেকটা অংশ জুড়ে কিচেন, মস্ত ডাইনিং হল এবং খালাসিদের থাকার জন্য ছোট ছোট কুঠুরি।
লোয়ার ডেক থেকে তিরিশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে আপার ডেক। এখানেও বেশ কটা কেবিন রয়েছে। এগুলো জাহাজের ক্যাপ্টেন, ডেপুটি ক্যাপ্টেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, তার সহকারী, ওয়ারলেস অপারেটর, ডাক্তার এবং খুব বেশি দামের টিকেটওলা কিছু প্যাসেঞ্জারদের জন্য। এখানে রয়েছে অগুনতি লাইফ-বেল্ট। কোনও দুর্ঘটনায় জাহাজ ডুবি হলে সেগুলো আঁকড়ে সমুদ্রে ভেসে থাকা যায়। লোয়ার ডেকে যে চিমনিটা রয়েছে সেটাই এখানকার ছাদ ফুঁড়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। এই ডেকের চার ভাগের তিন ভাগ খোলা, লোয়ার ডেকের চাইতেও অনেক বেশি ডেক চেয়ার সামনের দিকে সাজিয়ে রাখা আছে। পেছনের অংশে জাহাজের অফিস।