বাচ্চাগুলোর কিন্তু তাদের মা-বাপের মতো দুর্ভাবনা নেই। তারা হইচই করে শেডের তলায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
চকিতে তারপাশা স্টিমার ঘাটের সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে ফুটে ওঠে। হাজার হাজার আতঙ্কগ্রস্ত, উৎখাত মানুষ সেখানে খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন রুদ্ধশ্বাসে পড়ে থেকেছে। কখন স্টিমার এসে তাদের গোয়ালন্দে পৌঁছে দেবে সেই আশায়। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন ধরে তারা জন্মের শোধ চলে যাবে ইন্ডিয়ায়। তারপাশার মতো অত না হলেও যে শপাঁচেক মানুষ খিদিরপুর ডকে দলা পাকিয়ে বসে আছে তাদের চোখমুখেও তীব্র উৎকণ্ঠা। জাহাজে করে বঙ্গোপসাগরের যে অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে কীভাবে তারা বেঁচে থাকবে, কেমন করে গড়ে তুলবে তাদের নতুন বাসভূমি-হয়তো এইসব চিন্তাই তাদের ব্যাকুল করে রেখেছে।
রিফিউজিরা এক দিকে, অন্যদিকে প্রচুর চেয়ার টেবল। সেখানে বসে আছেন হিরন্ময় চৌধুরি, পরিতোষ পালিত, প্রিয়নাথ গুপ্তভায়া এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের আরও কয়েকজন অফিসার।
রয়েছেন দুজন ডাক্তার। তাদের সামনের মস্ত টেবলে প্রচুর ওষুধপত্র। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। তবে সবচেয়ে বেশি করে যারা নজর কাড়ছে তারা হল নিরঞ্জন আর বিভাস। তারা এই মুহূর্তে ভীষণ ব্যস্ত।
বিভাসের মুখে একটা টিনের লম্বাটে চোঙা। সে রিফিউজিদের দিকে ফিরে কিছুক্ষণ পর পর হেঁকে উঠছে, হরিপদ বিশ্বাস, গগন জয়ধর-আপনেরা ফেমিলি লইয়া ডাক্তারবাবুগো কাছে আহেন–
দুটো উদ্বাস্তু পরিবার ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে এসে দুই ডাক্তারের সামনে এসে কাতার দিয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তাররা তাদের পেট টিপে, বুকে স্টেথোস্কাপের নল ঠেকিয়ে পরীক্ষা টরীক্ষার পর একটা করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছেন। হাতে ছুঁচ ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাগুলো পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ছে।
দুটো পরিবারের পর অন্য দুই পরিবারকে ডাকল বিভাস। কেন উদ্বাস্তুদের ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে, বুঝতে পারছিল না বিনয়। হঠাৎ নিরঞ্জনের নজর এসে পড়ে তার ওপর। সারা মুখে খুশি ছড়িয়ে পড়ে। কাছে এগিয়ে এসে বলে, আইয়া গ্যাছেন! গুড। খাড়ইয়া ক্যান? হিরন্ময়রা যেখানে বসে আছেন সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওইহানে গিয়া বহেন–
নিরঞ্জন জানায়, ফি দফায় উদ্বাস্তুদের আন্দামানের জাহাজে তোলর আগে মেডিকেল চেক-আপ করানো হয়। দেওয়া হয় কলেরার ইঞ্জেকশন।
বিনয়ের মাথায় খানিক আগের দৃশ্যটা ঘুরছিল। সে মহারাজা জাহাজটা দেখিয়ে বলে, ওটায় করে তো রিফিউজিদের যাবার কথা। কিন্তু অন্য প্যাসেঞ্জাররা উঠছে যে?
নিরঞ্জন বিশদ বুঝিয়ে দিল, নানা কাজে প্রতি মাসে আন্দামান থেকে সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের কর্মীরা কলকাতায় আসে। ব্যবসাদাররা আসে মালপত্র নিয়ে যেতে। এক সপ্তাহ থেকে এখানকার কাজ সেরে সেই জাহাজেই তারা ফিরে যায়। তাছাড়া অন্য প্যাসেঞ্জাররাও রয়েছে। উদ্বাস্তুদের তাদের সঙ্গেই নিয়ে যাওয়া হয়। সাধারণ যাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা আপার ডেকে, কিংবা কেবিনে। সমুদ্রযাত্রায় উদ্বাস্তুদের রাখা হয় জাহাজের খোলের ভেতর। সেখানে রয়েছে সারি সারি বাঙ্ক।
নিরঞ্জন বলল, জাহাজে উঠলে নিজের চোখে হগল দ্যাখতে পাইবেন।
ওদিকে গিরিগঞ্জের হলধর সূত্রধর বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। উদ্বাস্তুদের ভিড় থেকে সে উঠে আসে। বলে, হেই কহন থিকা পথের দিকে তাকাইয়া বইয়া আছি। একবার ভাবলাম আপনে বুঝিন আইলেন না। পরে চিন্তা কইরা দ্যাখলাম, হ্যামকত্তার নাতি যহন কথা দিছে, ঠিকই আইৰ। আপনেরে দেইখা কী ভালা যে লাগতে আছে! তাকে বেশি উদ্দীপ্ত দেখালো।
নিরঞ্জন বিনয়কে বলে, আপনেরা কথাবার্তা কন। আমি ওই দিকটা দেহি। অহনও (এখনও) পঁচিশ-তিরিশখান ফেমিলির মেডিক্যাল চেক-আপ বাকি। সে চলে গেল।
বিনয় হলধরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, দমদম ক্যাম্প থেকে আপনারা কখন এসেছেন?
হেই হকাল বেলায় চা-রুটি খাওনের পর দশখান লরিতে কইরা অপিছারেরা (অফিসারেরা) আমাগো এইহানে লইয়া আইছে।
দুপুরে কি এখানেই খেলেন?
হ। ভালাই খাওয়াইছে। ভাত, ডাইল, বাইগন (বেগুন) ভাজা, রুই মাছের ঝো? আর দই।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে হলধর এপাশে ওপাশে তাকিয়ে আচমকা গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে দেয়। ছুটোবাবু, এইদিকে এক কাণ্ড অইয়া গ্যাছে। অপিছাররা অহনও ট্যার পায় নাই।
হলধরের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু রয়েছে যাতে চমকে ওঠে বিনয়। একটা চাপা উদ্বেগও বোধ করে। বলে, কী হয়েছে?
জাহাজ জুহাজ দেইখা ডরে ছয়টা রিফুজ ফেমিলি পিছন দিক দিয়া চুপে চুপে পলাইয়া গ্যাছে বলে যে বিশাল শেডটার তলায় উদ্বাস্তুরা বসে আছে তার ওধারটা দেখিয়ে দেয়। সেদিকে আরও একটা গেট রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, নিরঞ্জনরা যখন অন্যদিকে ব্যস্ত সেই সময় ওদিক দিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়া যায়। ছটা ফ্যামিলি সেই সুযোগটাই নিয়েছে। এটা এক মহা সংকট। রঞ্জনরা চায়, আন্দামান পুরোপুরি বাঙালি উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ হয়ে উঠুক। প্রতি খেপে যতগুলো ডি পি ফ্যামিলি যাবার কথা ঠিক ততগুলোই যাক। একটাও যেন কম না হয়। যখন ধরা পড়বে ছটা পরিবার কমে গেছে, তখন নতুন এই সমস্যাটা কীভাবে সামাল দেবে নিরঞ্জনরা, কে জানে।