অপার বিস্ময়ে ঝুমার দিকে কিছুক্ষণ হতবাক তাকিয়ে থেকেছে বিনয়। রাজদিয়ায় যে ঝুমাকে সে দেখেছে সে তেমনটি নেই, আগাগোড়া বদলে গেছে। কলকাতায় আসার পর তার অনেকখানি পরিবর্তন লক্ষ করেছিল বিনয়। কিন্তু যে নারী তার যা প্রিয়, তার যা কাম্য, সমস্ত কিছু সবলে ছিনিয়ে নিতে পারে, তাকে আগে কখনও কাঁদতে দেখা যায়নি।
বিনয় জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে ঝুমা, কাঁদছ কেন?
ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় ঝুমা বলেছে, তুমি কলকাতায় থাকবে না, আমার কী খারাপ যে লাগছে!
আমি কী একেবারেই চলে যাচ্ছি। কাজ শেষ হলেই চলে আসব।
কবে শেষ হবে? কতদিন ওখানে থাকবে?
এখানে বসে কী করে বলব? আগে তো যাই। আন্দামানে পৌঁছে সব দেখি। তারপর জানতে পারব ওখানে কতদিন থাকা দরকার।
মুখ থেকে হাত সরিয়ে সজল চোখে তাকিয়েছে ঝুমা। ব্যাকুল স্বরে বলেছে, তোমাকে ছেড়ে আমি কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারব না।
পাগল মেয়ে– বলতে বলতে ঝুমার কাঁধে একটা হাত রেখেছে বিনয়।
সেই স্পর্শে আচমকা ইন্দ্রজালের মতো কী যেন হয়ে যায়।
ঝুমা বিনয়ের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রগাঢ় আবেগে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, আন্দামানে গিয়ে রোজ আমাকে একটা করে চিঠি লিখবে। বুঝব, তুমি আমার কাছেই আছ। লিখবে ত? আমার কথা মনে থাকবে?
রাজদিয়ায় সদ্য কিশোরী ঝুমা কোনও কোনও বিজন দুপুরে তাকে বুকের ভেতর টেনে নিত। আজ সে পূর্ণ যুবতী। ঝুমার হাত, মুখ, গলা, স্তন, সব মোমের মতো গলে গলে বিনয়ের শরীরে মিশে যাচ্ছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খেলতে থাকে তার। আন্দামানে গিয়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কোথায় সে থাকবে, কোন গহন বনভূমিতে বা পাহাড়ে, সেই সব জায়গায় পোস্ট অফিস আছে। কি না, কিছুই জানা নেই। ঝুমার হৃৎপিণ্ডের উত্থান পতন বুকের ভেতর অবিরল অনুভব করতে করতে তা আর খেয়াল থাকেনি। প্রিয় নারীটির আবেগ, আকুলতা তার মধ্যেও চারিয়ে যাচ্ছিল। গাঢ় গলায় বিনয় বলেছে, নিশ্চয়ই লিখব
এবার মুখ তুলে বিনয়ের ঠোঁটের ওপর তার দুই উষ্ণ, রক্তাভ ঠোঁট স্থাপন করেছে ঝুমা। কলকাতায় আসার পর এই তার প্রথম চুম্বন। অফুরান মাধুর্য ছড়িয়ে ছড়িয়ে তা বিনয়ের স্নায়ুমণ্ডলীকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই নারীটির চুম্বন যে কী মাদকতাময়!
অনেকক্ষণ পর ঝুমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বিনয়। তার সঙ্গে সঙ্গে সদর পর্যন্ত এসেছে ঝুমা। খানিকটা চলার পর রাস্তার মোড়ে এসে একবার পেছন ফিরেছে সে। দরজার। ফ্রেমে তার কাম্য নারীটি কোনও রমণীয় ভাস্কর্যের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।
.
রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়ল বিনয়। মালপত্র ডিকিতে ভরে দেওয়া হয়েছে। প্রসাদ তাকে খিদিরপুর ডকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। সে রাজি হয়নি। বিনয় এখন আর রাজদিয়ায় সেই গেঁয়ো, জড়সড়, লাজুক যুবকটি নেই। তার ওপর এই কমাসে শহুরে পালিশ পড়ে গেছে। এখন সে অনেক বেশি সপ্রতিভ। অনেক উদ্যমী। অনেক তৎপর। কারও সাহায্য ছাড়াই একা-একা যেখানে সেখানে হুটহাট চলে যেতে পারে।
খিদিরপুর ডকের বাইরে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে এক হাতে সুটকেস, আর-এক হাতে হোল্ড-অল ঝুলিয়ে বাইশ নম্বর গেটের পাশের জেটিতে চলে এল। সেখানে বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেটার গায়ে লেখা : এস এস মহারাজা। এস এস মানে স্টিমশিপ।
জাহাজটার গায়ে লম্বা উঁচু সিঁড়ি লাগানো। নিচে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজ কোম্পানির লোকেরা। বেশ কিছু যাত্রী সেখানে জড়ো হয়েছে। চেহারা দেখে মনে হয় না উদ্বাস্তু। তারা কোম্পানির লোকেদের টিকেট এবং দরকারি কাগজপত্র দেখিয়ে একে একে জাহাজে উঠছে। জেটির একধারে পাহাড়প্রমাণ মালপত্র টাল দিয়ে রাখা আছে। বিরাট বিরাট টিন বোঝাই সরষের তেল, বনস্পতি ঘি, নারকেল, তেল, বস্তা বস্তা আলু, পেঁয়াজ, ডাল, মশলা, নুন, গুড়, চিনি, আটা, ময়দা, গাঁট গাঁট কাপড়, বাক্স বাক্স ওষুধ, সিগারেট, বাসন কোসন, ইলেকট্রিক্যাল গুডস-জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন সমস্ত কিছু। প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে কুলিরা সেইসব মাল মাথায় চাপিয়ে জাহাজে রেখে এসে ফের নিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে খেপের পর খেপ।
বিনয় শুনেছে, দৈনন্দিন প্রয়োজনের সমস্ত জিনিস প্রতি মাসে জাহাজে করে আন্দামানে নিয়ে যাওয়া হয়। এক মাস কোনও কারণে যদি জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকে, দ্বীপের মানুষজনকে উপোস করে থাকতে হবে।
মহারাজা জাহাজে দমদম ক্যাম্পের শরণার্থীদের যাবার কথা। কিন্তু যাচ্ছে অন্য লোকজন। বিনয় বেশ ধন্দে পড়ে যায়। তবে কি উদ্বাস্তুরা এখনও এসে পৌঁছয়নি?
এধারে ওধারে তাকাতে হঠাৎ বিনয়ের চোখে পড়ে বেশ খানিকটা দূরে বিরাট লম্বা শেডের তলায় দড়ির ঘেরের ভেতর অগুনতি মানুষ গা ঘেঁষেঘেষি করে বসে আছে। অতি পরিচিত, ক্ষয়াটে সব চেহারা।
উদ্বাস্তুদের তাহলে আলাদা করে ওখানে রাখা হয়েছে। বড় বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় বিনয়।
একদিকে উদ্বাস্তুদের জটলা। সেখানে সারি সারি মলিন, ভয়ার্ত মুখ। বেশির ভাগই চুপচাপ। জাহাজ, ডক, বন্দরের ব্যস্ত কর্মীদের দেখে তারা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেছে। বিহুলের মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। বাকি সবাই নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, আসন্ন সুমদ্রযাত্রা নিয়ে তারা ভীষণ চিন্তিত। তাদের পাশে রয়েছে রং-চটা দড়িবাঁধা বিছানা, তোবড়ানো সিলভারের হাঁড়িকুড়ি, বালতি, জং-ধরা দা, বঁটি, কুলো থেকে আঁটা, জাঁতি-অর্থাৎ পার্থিব সম্পত্তি বলতে যার যেটুকু ছিল সব নিয়ে এসেছে। এমনকি ক্যাম্পের ফাঁকা জমিতে যে লাউগাছ বা ডাটা ফলিয়েছিল তাও কেটে এনেছে।