হেমনাথের জন্য আশ্চর্য এক আবেগে যেন ভাসছিল বিনয়। সে তার নাতি, একমাত্র সেই কারণে তার কথায় সমস্ত সংশয়, দ্বিধা আর আতঙ্ক কাটিয়ে হলধর আন্দামানে পাড়ি দিতে রাজি হয়েছে। এটা যে কী বিরাট গর্বের, কত আস্থার ব্যাপার, শুধু সে-ই জানে। দেশভাগ হবার পর রাজদিয়া এবং তার চারপাশের পঁচিশ তিরিশটা গ্রাম-গঞ্জের মানুষ কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু তাদের একজনও তাঁকে ভোলেনি। অজস্র ছিন্নমূলের স্মৃতিতে রাজদিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষটি অনন্ত মহিমা নিয়ে থেকে গেছেন।
অবশ্য এটাও সত্যি, হলধরের মতো মানুষগুলো রিলিফ ক্যাম্পে ধ্বংস হয়ে যেতে যেতে হতাশার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের মনের অতল স্তরে হয়তো এমন একটা মরিয়া ভাবনা লুকানো ছিল, এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে মানুষের মতো বাঁচার চেষ্টা করবে। কিন্তু তেমন মনোবল ছিল না। হেমনাথের নামটা হলধরকে অসীম সাহস জুগিয়েছে। তার দেখাদেখি কুঁকড়ে-থাকা অন্য অনেকেই ভয় আর সংশয়ের ঘেরাটোপ ভেঙে অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপ দিতে মনস্থির করে ফেলেছে। যাই হোক, হেমনাথ সম্পর্কে হিরন্ময়কে সবিস্তার জানিয়ে দিল বিনয়। গভীর আগ্রহে সব শোনার পর সসম্ভ্রমে তিনি বললেন, নমস্য মানুষ। একটু চুপ করে থেকে বিভাসের দিকে ফিরলেন, তুমি তো ভাই বিরাট সমস্যা তৈরি করে এলে–
বিভাস অবাক হল। কীসের সমস্যা?
ক্যাম্পের রিফিউজিদের কাছে আপেল, আঙুর আর ডায়মণ্ডহারবারের কাছে চর পড়ার গল্প ফেঁদে এসেছ। যখন ওরা গিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না তখন কী হবে?
তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল বিভাস। হেইটা আমাগো উপুর ছাইড়া দ্যান। ঠিক সামলাইয়া লমু। খানিক ভেবে বলে, আন্দামানের মাটিতে যহন সোনার ধান ফলব, আপেল আঙুরের কথা হেগো, মনেও থাকব না।
আর চরের ব্যাপারটা?
যহন ওরা জিগাইব, বানাইয়া বুনাইয়া কিছু এটা কইয়া দিমু। এই নিয়া চিন্তা কইরেন না দাদা–
.
চোখের পলকে তিনটে দিন শেষ।
নিরঞ্জনরা জানিয়ে দিয়েছিল, সোমবার খিদিরপুর ডকের বাইশ নম্বর গেট থেকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দামানের জাহাজ ছাড়বে। জাহাজের নাম এস এস মহারাজা। রবিবার বিকেলের মধ্যেই বিনয়। যেন ডকে পৌঁছে যায়। সন্ধে আটটার ভেতর এম্বারকেশন, অর্থাৎ জাহাজে চড়তে হবে। বাকি রাতটা। কলকাতায় কাটিয়ে সোমবার ভোরে এ এস মহারাজা আন্দামানে রওনা হবে।
এই তিনটে দিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না বিনয়ের। পায়ে চাকা লাগিয়ে সে যেন উড়ে বেড়াচ্ছিল। শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায়।
অফিস থেকে তাকে জাহাজের টিকেট কেটে দেওয়া হয়েছে। কেবিনের টিকেট। খরচাপাতির জন্য সেই সঙ্গে নগদ দুহাজার টাকা। যদি আরও দরকার হয়, টেলিগ্রাম করলে টি এম ও করে পাঠানো হবে।
আন্দামানে জগদীশ গুহঠাকুরতার এক বন্ধুর ছেলে ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট, তাছাড়া রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের কিছু দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়। নাম বিশ্বজিৎ রাহা। জগদীশ তাকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। অনুরোধ করেছেন আন্দামানে বিশ্বজিৎ যেন রিফিউজিদের মধ্যে বিনয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে যেন লক্ষ রাখেন।
অচেনা নতুন জায়গায় যাচ্ছে। জামাকাপড় খুব একটা বেশি নেই বিনয়ের। কলকাতায় আসার পর আনন্দরা সেই যা কিনে দিয়েছিল। অফিসের টাকাটা পেয়ে কটা ধুতি, রেডিমেড শার্ট, পাজামা, এক জোড়া ফুল প্যান্ট, একটা বড় সাইজের চামড়ার সুটকেস কিনে ফেলল সে। কিনল হোন্ড-অল, পাতলা তোষক, বালিশ। এখন গরমের রেশ চলছে। লেপ-কম্বলের দরকার নেই। রাতে যদি শীত শীত করে, তাই গায়ে দিয়ে শোবার জন্য একটা মোটা খদ্দরের চাদরও কিনে নিল। তাছাড়া দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, দুটো ওয়াটারম্যান পেন, দুশিশি কালি, ডায়েরি, এমনি টুকিটাকি নানা জিনিস। রিপোর্ট লেখার জন্য অফিস থেকে অবশ্য ডজন দুয়েক মোটা মোটা নিউজপ্রিন্টের প্যাড দিয়েছে।
কেনাকাটা এবং গোছগাছের ফাঁকে একদিন সে টালিগঞ্জে সুধাদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। আন্দামানে যাচ্ছে শুনে সুধা তো কেঁদেকেটে সারা। সে কিছুতেই ভাইকে যেতে দেবে না। যদি জাহাজ-ডুবি হয়ে যায়? বিনয় বুঝিয়েছে, তারা স্টিমারে করে তারপাশা থেকে গোয়ালন্দে আসেনি? স্টিমার কি ডুবে গিয়েছিল?
সুধা বলেছে, সেখানে ছিল নদী। তুই যাবি সমুদ্রে। দুটো কি এক হল?
অনেক বোঝাবার পর খানিকটা শান্ত হয়েছে সুধা। ধরা ধরা গলায় বলেছে, আন্দামানে গিয়েই টেলিগ্রাম করবি
করব।
দ্বারিক দত্ত, সরস্বতী, হিরণ, এমনকি কাজের মেয়ে উমারও খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারা বলেছে, নতুন জায়গায় যাচ্ছে বিনয়, যেন খুব সাবধানে থাকে।
একদিন সুনীতিদের বাড়িতেও গিয়েছিল বিনয়। সুনীতি সুধার মতো কান্নাকাটি জুড়ে দেয়নি ঠিকই, তবে তার চোখ ছল ছল করছিল। হেমনলিনী, আনন্দ, মাধুরী, দীপক-কারওই মন ভাল ছিল না। সবাই বলেছে, বিনয়ের জন্য তারা চিন্তায় থাকবে। সময়মতো যেন খাওয়া দাওয়া করে। অনিয়ম যেন না হয়, ইত্যাদি।
সুনীতিদের বাড়ি থেকে সেদিনই বিনয় গিয়েছিল ঝুমাদের বাড়ি। দূরে কেউ কোথাও গেলে, আত্মীয় পরিজনেরা যা যা বলে থাকে, শিশির, স্মৃতিরেখা, রামকেশবরা ঠিক তা-ই বলেছেন। শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে একই উপদেশ, চলাফেরা সম্পর্কে একই ভাবে সতর্ক করে দেওয়া। শিশির, স্মৃতিরেখারা যখন কথা বলছিলেন, এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল ঝুমা। এক ফাঁকে সে বিনয়কে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেছে। খাটের একধারে তাকে বসিয়ে কাছাকাছি বসেছিল ঝুমা। দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছিল তার। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে ভেতরকার চাপা কষ্ট ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু শেষ অবধি পারেনি। কান্না উথলে বেরিয়ে এসেছে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে যাচ্ছিল সে।