তারপাশা থেকে কলকাতায় আসার সময় দেড় দিনেরও বেশি সময় তাদের একসঙ্গে কেটেছে। বিনয়ের মনে হয়েছিল, মহিলা স্বল্পভাষী। সারাক্ষণই বিমর্ষ। ম্রিয়মাণ। কিন্তু আজ প্রচুর কথা বলছে। বেশ অবাকই হল সে। বিব্রতভাবে কিছু একটা কৈফিয়ৎ দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার আগেই হয়তো বাসন্তীর খেয়াল হয়, বিনয়কে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যস্তভাবে বলল, আহেন, ভিতরে আসেন। আপনেরে আমাগো বড় দরকার–
বাসন্তীর পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সামান্য অস্বস্তি বোধ করে বিনয়। বিমল বাসন্তীর খুড়তুতো ভাই। নিজের পরিজনেরা থাকতে কেন তাকেই ওদের প্রয়োজন, কেন তার জন্য ওরা অপেক্ষা করে আছে, কে জানে।
.
১০.
সদর দরজা পেরুলেই মস্ত চাতাল। কোনও এক কালে, হয়তো পঞ্চাশ কি ষাট বছর আগে, ওটা যত্ন করে বাঁধানো হয়েছিল। চাকলা চাকলা সিমেন্ট উঠে এখন এবড়ো খেবড়ো, নানা জায়গায় ইট বেরিয়ে পড়েছে।
চাতালটার একধারে তিনটে এজমালি জলের কল। দুটো পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত জলের। টালার মস্ত ট্যাঙ্ক থেকে ওই জলটা দিনে তিনবার সাপ্লাই করা হয়। সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে। খাওয়া, স্নান, রান্নাবান্না–সব এই জল দিয়ে। তৃতীয় কলটা গঙ্গাজলের। দিনরাত ওটা পাওয়া যায়। সরবরাহে কোনও ছেদ নেই। এই জলটা ঘর ধোওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি মোটা কাজের জন্য ভীষণ জরুরি। মাসখানেকের মতো কলকাতায় কাটানোর ফলে এই শহরের ওয়াটার সাপ্লাই সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গেছে বিনয়ের।
সে জানে, সকালের দিকটায় এই মহানগরের লোকজনের ভীষণ ব্যস্ততা। তখন বাড়ির গিন্নিদের রান্নার তাড়া। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে যাবার তাড়া। বাড়ির কর্তাদের অফিসে যাবার তাড়া। যাদের দোকান বা অন্য ব্যবসাপত্তর আছে তাদের বেরুবার তাড়া।
ভেতরে পা দিয়েই বিনয় আঁচ করে নিল, গোটা তেতলা বাড়িটা আগাপাশতলা ভাড়াটেতে ঠাসা। কলতলায় এখন মেলা বসে গেছে। বড় বড় টিনের বালতি, গামলা, ডেকচি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে অনেকে। বিশেষ করে নানা বয়সের মেয়েরা। কিশোরী, যুবতী এবং মাঝবয়সী গিন্নিবান্নিরা তো আছেই, বেশ কজন পুরুষকেও দেখা গেল। কে আগে জল নেবে, কার বেরুবার বেশি তাড়া, এই নিয়ে রীতিমতো বচসাও চলছে। ওদিকে তিনটে পায়খানার সামনেও লাইন। কয়েকজন জলের বালতি এবং মগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিম্নগামী বেগ সামলাচ্ছে। বাসন্তী যে একটি অচেনা যুবককে বাড়িতে নিয়ে এসেছে, এই মুহূর্তে তার দিকে কারও লক্ষ্য নেই।
ঘরে ঘরে কয়লার উনুন ধরানো হয়েছে। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। একতলায়, দোতলায়, তেতলায়–সর্বত্র।
চাতালটা ঘিরে সারি সারি ঘর। সেগুলোর সামনে দিয়ে টানা, চওড়া বারান্দা।
চাতালের আধাআধি পেরিয়ে ডান পাশে যেতে যেতে বাসন্তী ডাকতে লাগল, মা মা, দ্যাখো ক্যাঠা (কে) আইছে।
কোণের দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন রামরতনের স্ত্রী। তার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনয়ের। হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে যায়। শিয়ালদা স্টেশনে শেষ তাকে দেখেছে সে। স্বামীর মৃতদেহ আগলে অঝোরে কাঁদছিলেন। তখনও তার পাকা চুলের সিঁথিতে ডগড়গে সিঁদুরের টান। কপালে মস্ত সিদুরের টিপ। হাতে ধবধবে শাখা, লাল পলা আর রুপো-বাঁধানো লোহা। পরনে লাল-পাড় শাড়ি। আর এখন? সিঁদুর নেই। শাখা নেই। লোহা নেই। গায়ে সাদা ফ্যাটফেটে সেমিজ আর থান। কদিনে বৃদ্ধা আমূল বদলে গেছেন। যেন অচেনা এক বিষাদপ্রতিমা। তার এই চেহারা চোখে শেল বেঁধাতে থাকে বিনয়ের।
তাকে দেখে হঠাৎ যেন একটু উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন রামতরনের স্ত্রী, আসো বাবা, আসো,
পাশের একটা ঘর থেকে ছায়া আর মায়াও বেরিয়ে এসেছিল। কেমন যেন জড়সড়, ত্রস্ত। চকিতের জন্য বিনয়ের মনে হয়, ওরা কি এখানে ভাল নেই? লক্ষ করল, তাকে দেখে দুই তরুণীর মুখে ক্ষীণ আভা ফুটে উঠেছে।
বিনয় খুব অবাকই হয়। বাসন্তী জানিয়েছে ছায়া-মায়া এবং তাদের মা বিমলের বাসায় আসার পর থেকে তার জন্য অধীরভাবে দিন গুনে যাচ্ছে। ভাবনায় আবছা একটা ছায়া পড়ে। এই চার রমণীর তার কাছে কি কোনও প্রত্যাশা আছে?
একটা ছোট ঘরে বিনয়কে এনে বসানো হয়। খুবই সাধারণ সাজসজ্জা। খানচারেক সস্তা চেয়ার, একটা নিচু চৌকো টেবল, সেকেলে ধাঁচের কাঁচের আলমারিতে বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র এবং আধুনিক লেখকদের কিছু বই, দেওয়ালে ইংরেজি-বাংলা মেশানো বড় মাপের ক্যালেন্ডার, একধারে সুজনি-ঢাকা সরু তক্তপোশ, মাথার ওপর লম্বা উঁটিওলা মান্ধাতার আমলের ফ্যান।
বাসন্তীরা দাঁড়িয়ে আছে। বিনয় বলল, আমি তো বসে পড়লাম। আপনারাও বসুন–
অনেক বলার পর রামরতনের স্ত্রীই শুধু কুণ্ঠিতভাবে একটা চেয়ারে বসলেন। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যা, বিনয়ের লেইগা চা কইরা লইয়া আয়–
বিনয় আপত্তি করতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছায়া মায়া ছুটে বেরিয়ে গেছে।
এদিক সেদিক তাকিয়ে বিনয় জিজ্ঞেস করল, আপনারাই শুধু রয়েছেন। বিমলবাবুকে তো দেখছি না। তিনি কোথায়?
বৃদ্ধা বললেন, বিমল গ্যাছে র্যাশনের দোকানে। র্যাশন তুইলা, বাজার কইরা ফিরব। আইজ হ্যায় (সে) অফিস যাইব না। অর (ওর) বউ হের (তার) পোলামাইয়া লইয়া সখের বাজারে বাপের বাড়িত গ্যাছে। আইজ আর ফিরব না।