বিভাস সাহা নিরঞ্জনের পাশ থেকে বলে ওঠে, আরও একহান জবর খবর দেই। আন্দামানের জঙ্গলে শয়ে শয়ে গাছে আপেল আঙুর ফইলা রইছে। পইড়া পইড়া পচতে আছে। যাইবেন, পাড়বেন আর খাইবেন।
বিভাসের দিকে হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। আন্দামানের বনভূমি আপেলে আঙুরে ছেয়ে আছে। এমন তথ্য তার জানা নেই। ওদিকে হিরন্ময়রাও বিহুলের মতো বিভাসকে লক্ষ করছিলেন। আপেল এবং আঙুরের ব্যাপারটা তাঁদেরও খুব সম্ভব দিশেহারা করে ফেলেছে।
বিভাসের কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। হাত-পা-মাথা ঝাঁকিয়ে বিপুল উদ্দীপনায় সে বলে চলেছে, বুঝতে পারি জাহাজে উঠতে হইব বইলা আপনেরা ডরাইয়া গ্যাছেন। কুনো চিন্তা নাই। মোটে একহান রাইত। ডায়মণ্ডহারবার পার হইলেই দ্যাখবেন চর পড়ছে। হেইহানে আপনেগো নামাইয়া দিমু। হাইটা হাইটা (হেঁটে হেঁটে) আন্দামান চইলা যাইবেন। প্রবল তোড়ে কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে।
আপেল, আঙুর, ডামণ্ডহারবার পেরুলে চর–চমকের পর চমক। হিরন্ময়রা বিভাসকে বাধা দিতে গিয়েও থমকে গেছেন। কেননা ওকে থামাতে গেলে তার ফল ভাল হবে না। উদ্বাস্তুরা এমনিতেই আন্দামানে যাবার ব্যাপারে ভীষণ অনিচ্ছুক। তার ওপর যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় বিভাস ঝুড়ি ঝুড়ি ফাঁকা আশ্বাস দিচ্ছে, ওরা পুরোপুরি বেঁকে বসবে। দমদমের এই সব ক্যাম্প থেকে অন্য ত্রাণ শিবিরগুলোতেও ব্যাপারটা মুহূর্তে চাউর হয়ে যাবে। আন্দামানে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন পরিকল্পনা তাতে বানচাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
এদিকে চারপাশে যে তুমুল হট্টাগোল চলছিল সেটা ঝিমিয়ে এসেছে। জনতা ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করতে থাকে। আসলে নিরঞ্জন আর বিভাস চোখের সামনে একটা স্বর্গের ছবি টাঙিয়ে দিয়েছিল। তার নীট ফল আন্দামান সম্পর্কে উদ্বাস্তুদের আতঙ্ক অনেকটাই কেটেছে। তবে দ্বিধাটা রয়ে গেছে। সেই কারণেই খুব সম্ভব এত পরামর্শ।
হঠাৎ ভিড় ঠেলে ঠেলে একটা বুড়োমতো লোক, বয়সের ভারে কুঁজো, বিনয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতজোড় করে বিনীতভাবে বলে, আমারে চিনতে নি পারলেন ছুটোবাবু?
মুখটা চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারল না বিনয়। বিব্রতভাবে বলল, ঠিক মানে-।
আমি হলধর সূত্রধর। গিরিগুঞ্জে বাড়ি আছিল। রাইজদায় আপনেগো বাড়ি মাঝে মইদ্যে গ্যাছি। হ্যামকত্তায় কতভাবে যে আমার উপকার করছেন। তেনি আমার বাপের লাখান
এবার আবছাভাবে মনে পড়ল বিনয়ের। সে বলে, আপনি এখানকার ক্যাম্পে কতদিন আছেন?
মাস দুই হইল। হলধর জানায়, দেশভাগের পর তারা আসাম চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে টেকা গেল না। ফের উৎখাত হয়ে বউছেলেমেয়ের হাত ধরে শিয়ালদায় এসেছিল। সেখান থেকে দমদমের এই ত্রাণশিবিরে।
একটু চুপচাপ।
তারপর হলধর আর-একটু কাছে এগিয়ে এসে হিরন্ময়দের দেখিয়ে খুব নিচু গলায় বলে, ওই ছারেরা (স্যারেরা) আন্ধারমানে লইয়া যাইতে চায়। আপনে তো ওনাগো লগে আইছেন। ওনারা যা কইল হের উপুর ভরসা রাখন যায়?
আপেল, আঙুর এবং চরের ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বিনয় বলল, আন্দামানে গেলে জমিজমা নিশ্চয়ই পাবেন। শুনেছি ওখানকার জমি খুব ভাল। একটু থেমে ফের বলে, যদি গিয়ে দেখেন জায়গাটা পছন্দ হচ্ছে না, ফিরে আসবেন। আপনাদের সঙ্গে আমিও যাব।
হলধরের সংশয় ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। চেহারায় একটা সজীব ভাব ফুটে ওঠে। উৎসাহের সুরে সে বলে, সহত্যই যাইবেন ছুটোবাবু? সহত্যই যাইবেন?
বললাম তো-যাব।
এবার এক কাণ্ডই করে বসে হলধর। সোজা হিরন্ময়ের কাছে এসে বলে, রাইজদার হ্যামকত্তার নাতি আন্ধারমান যাইব। তেনি যহন যাইতে আছেন, আমার ফেমিলিও যাইব। আমাগো নামগুলানে দাগ মারেন ছার। এক লহমা ভেবে বলল, কেম্পে পেরায় মইরাই আছি। এইভাবে কি মাইনষে বাইচা থাকতে পারে! আন্ধারমানে গ্যালে আপনেরা যা দিবেন কইলেন, পাইলে বাচুম। নাইলে মরুম। কেম্পেও মরতাম। আন্ধারমানে গিয়াও না হয় মরুম। মরার আগে আন্ধারমানে গিয়া একবার না হয় দেখি। একহান বড় ভরসা হ্যামকত্তার নাতি লগে যাইব–
কে হেমকর্তা, পৃথিবীর কোন প্রান্তে রাজদিয়া নামের ভূখণ্ডটি রয়েছে, সে সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও কোনও প্রশ্ন করেন না হিরন্ময়। একটা পরিবার আন্দামানে যেতে রাজি হয়েছে, সেটা তার কাছে দিগ্বিজয়ের মতো ব্যাপার। টাইপ-করা কাগজ হাতড়ে হলধরদের নামগুলো বার করে দাগ মেরে দেন।
হলধর সূত্রধরের ফ্যামিলি সাহস করে আন্দামান যেতে চাইছে। এটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়ার মতো কিছু ঘটিয়ে দেয়। অন্য উদ্বাস্তুরাও একে একে হিরন্ময়ের কাছে এসে জানায় তারাও যাবে। ক্যাম্পে পোকামাকড়ের মতো জীবন না কাটিয়ে বঙ্গোপসাগরের সুদূর দ্বীপপুঞ্জে বাঁচার জন্য শেষ একটা চেষ্টা তারা করবে।
এক ঘন্টার ভেতর এক শ পরিবারের নামের পাশে দাগ পড়ে যায়।
তারপর হিরন্ময় চার ক্যাম্পের অফিসার-ইন-চার্জদের বলেন, সোমবার আন্দামানের জাহাজ ছাড়বে। তার আগের দিন, মানে রবিবার কয়েকটা লরি পাঠিয়ে দেব। সেগুলো রিফিউজিদের খিদিরপুর ডকের বাইশ নম্বর গেটে পৌঁছে দেবে। আপনারা এখানকার সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।
অফিসাররা সমস্বরে বলেন, নিশ্চয়ই স্যার।
.
৭৫.
ত্রাণশিবিরগুলোতে কাজ শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। বিনয়রা এখন ফিরে চলেছে। হিরন্ময় বিনয়কে লক্ষ করছিলেন। বললেন, আপনি একেবারে মিরাকল করে দিলেন। আপনার সাহায্য ছাড়া ক্যাম্পের রিফিউজিদের আন্দামানে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন হত। একটু ভেবে ফের বললেন, হলধর সূত্রধরের কথা শুনে মনে হল সে আপনার দাদু হেমকর্তার ভীষণ ভক্ত। ওই মানুষটি সম্পর্কে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।