কিন্তু শোক, দুঃখ বা মানসিক আঘাতের তীব্রতা চিরস্থায়ী হয় না। ধীরে ধীরে জাগতিক নিয়মেই তার উপশম ঘটে।
তিনদিনের দিন সকালবেলা চা খেয়ে, বাসি জামাকাপড় পালটে বিনয় বলল, হিরণদা, ছোটদি, আমি একটু বেরুচ্ছি।
মাঝখানের দুটো দিন শুয়ে বসে, অস্থিরভাবে পায়চারি করে বা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে কাটিয়ে দিয়েছে বিনয়। কিন্তু দোতলার কটা কুঠুরির ভেতর আটকে থাকতে আজ আর ভাল লাগছে না। বড় বেশি একঘেয়ে মনে হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তিকর।
সুধা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবি?
বিনয় বলল, এই একটু ঘুরে টুরে আসি।
সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিল হিরণ, ঘুরেই আসুক। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকার মানে হয় না।
সুধা বলল, বেশি দেরি করিস না।
আচ্ছা–
ট্রাম রাস্তায় এসে ফুটপাথ ধরে টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের দিকে হাঁটতে লাগল বিনয়। বিশেষ কোনও গন্তব্য নেই। কেমন যেন দূরমনস্ক। লক্ষ্যহীন।
ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর কটা দিন উদভ্রান্তের মতো এই শহরের বড় বড় রাস্তা এবং জিলিপির প্যাঁচ-লাগা অগুনতি অলিগলিতে ছুটে বেড়িয়েছে বিনয়। তার উদ্যম প্রায় শেষ। উদ্দীপনা স্তিমিত। আশাও প্রায় বিলীন। ক্রমশ সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, ঝিনুককে আর কখনও পাওয়া যাবে না। বৃথাই কলকাতার পথে পথে ঘুরে জীবনীশক্তিকে ক্ষয় করে ফেলা।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সাদার্ন অ্যাভেনিউর কাছাকাছি চলে এসেছে, খেয়াল নেই। আচমকা রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা মনে পড়ে গেল। জামতলির বৃদ্ধ, শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইটি প্রায় সমস্ত জীবন জাতিগঠনের কাজে কাটিয়ে দিয়েছেন। শেষ বয়সে শরীর যখন অশক্ত, জরার ভারে পিঠ নুয়ে পড়েছে, সেই সময় এক কাপড়ে পাকিস্তান থেকে তাঁকে ভয়ে আতঙ্কে পূর্বপুরুষের বাসভূমি ছেড়ে ইন্ডিয়ার দিকে পা বাড়াতে হয়েছিল। সম্পূর্ণ নিঃস্ব। মাথার ওপর পাষাণভারের মতো বৃদ্ধা স্ত্রী, এক বিধবা এবং দুই তরুণী মেয়ে। তখন সারাক্ষণ মৃত্যুভয়। জলেস্থলে ঘাতকবাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল! এই বুঝি দুই যুবতী মেয়েকে কেড়ে নিয়ে গেল!
রাজদিয়ার আশু দত্তর সঙ্গে রামরতনের অনেকটাই মিল। তবে রামরতনের সমস্যা অনেক জটিল। তার স্ত্রী আছেন, তিন মেয়ে আছে। সেদিক থেকে আশু দত্ত প্রায় ঝাড়া হাত-পা। বৃদ্ধা অথর্ব মা ছাড়া তাঁর কেউ নেই।
তারপাশার স্টিমারঘাটে রামরতনদের সঙ্গে বিনয়ের প্রথম আলাপ। স্টিমারের ডেকে গাদাগাদি ভিড়ে শয়ে শয়ে সর্বস্ব খোয়ানো শরণার্থীর সঙ্গে তারা এসেছিল গোয়ালন্দে। তারপর কলকাতার ট্রেন ধরেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌঁছনো আর হল না। জীবন্ত রামরতন আসতে পারেননি, এসেছিল তার নিষ্প্রাণ শরীর। পথেই তার যাবতীয় যন্ত্রণা আর দুর্ভাবনার অবসান ঘটে গেছে।
শিয়ালদায় রামরতনের ভাইপো বিমলকে বিনয় কথা দিয়েছিল, খুব শিগগিরই একদিন তাদের বাড়ি যাবে। কিন্তু শোকাতুর মানুষগুলোর কথা ভাবার মতো সময়ই পাওয়া যায়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কত কিছুই না ঘটে গেল। সুনীতিদের বাড়ি গিয়ে ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনা, সুধাদের কাছে আশ্রয় পাওয়া, খবরের কাগজে আনন্দর চাকরি জোগাড় করে দেওয়া, তীর্থস্থান থেকে অবনীমোহনের ফিরে আসা, ভবানীপুরের বাড়ি বিক্রি, ঝিনুকের প্রতি অবনীমোহনের হৃদয়হীন আচরণ, জনমদুখিনী মেয়েটার নিখোঁজ হওয়া, চিরকালের মতো অবনীমোহনের গুরুর আশ্রমে চলে যাওয়া। একের পর এক ঘটনা। একের পর এক সংকট। এ-সবের বাইরে তার চিন্তায় আর কিছুই ছিল না।
অঘ্রানের এই সকালে নরম শীতল রোদে যখন চারদিক ভরে আছে, উত্তুরে হাওয়ার দাপট টের পাওয়া যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, সেই সময় রামরতনের স্ত্রী এবং তার মেয়েদের জন্য এক ধরনের আকুলতা অনুভব করে বিনয়।
এখনও অফিস টাইমের ভিড় শুরু হয়নি। ট্রাম বাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা। রাস্তার ওপারে গিয়ে একটা দোতলা বাসে উঠে পড়ল বিনয়। ওটার দৌড় বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার।
বিমলদের ঠিকানা তার স্পষ্ট মনে আছে। তিরিশ নম্বর মদন বড়াল লেন। রামরতন গোয়ালন্দগামী স্টিমারের ডেকে পাশাপাশি বসে বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শ্যামবাজারে চিত্রা সিনেমার পাশ দিয়ে মিনিট দুই হাঁটলেই বাঁ দিকের গলিটাই মদন বড়াল লেন।
দোতলা বাসটা আধ ঘণ্টার মধ্যে চিত্রা সিনেমার সামনে বিনয়কে পৌঁছে দিল। তারপর বিমলদের বাড়িটা খুঁজে বার করতে বেশিক্ষণ লাগল না।
এলাকাটা পুরানো এবং ঘিঞ্জি। গায়ে গায়ে সব বাড়ি। সবই সাদামাঠা, কারুকার্যহীন। কোথাও পাঁচ ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা নেই। তবে আশেপাশে কোনও বস্তি টস্তি চোখে পড়ছে না।
বিমলদের বাড়িটা তেতলা। সদর দরজা হাট করে খোলা। রাস্তা থেকেই টের পাওয়া যায়, ভেতরে প্রচুর লোকজন। তাদের চলাফেরা, টুকরো টুকরো কথাবার্তা এবং বাসনকোসনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সূর্যোদয় হয়েছে অনেক আগেই। আনকোরা একটা দিন। ঘর-গেরস্থালির ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে।
বিনয় গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগল, বিমলবাবু–বিমলবাবু–
খানিক পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো বিমল নয়, রামরতনের মাঝবয়সী বিধবা মেয়ে বাসন্তী। বিনয়কে দেখে চকিতে তার চোখেমুখে চাপা আলোর মতো কিছু খেলে যায়। ব্যগ্র সুরে সে বলে, রোজই ভাবি আপনে আইবেন। কিন্তুক আহেন আর না। মায় (মা), আমি আর আমার দুই বইনে। রাস্তার দিকে তাকাইয়া থাকি। পরে ভাবলাম, পথের আলাপ। কে আর কারে মনে রাখে। চোখের আবডাল হইলে সগলে ভুইলা যায়—