দেখো, বাবার যেন কোনওরকম অসুবিধে না হয়–
খগেন জানায়, না, হবে না। পাঁচ বছর সে অবনীমোহনের সঙ্গে আছে। ছায়ার মতো। সেবাযত্নের কখনও ত্রুটি হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না।
হিরণ অবনীমোহনকে বলল, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনার হরিদ্বারের ঠিকানাটা নেওয়া হয়নি। পকেট থেকে কলম আর এক টুকরো কাগজ বার করল সে।
অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, ঠিকানা নিতে চাইছ কেন?
হিরণ থতিয়ে গেল, কোনও দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। সেই জন্যে
অবনীমোহন বললেন, হরিদ্বারের ঠিকানা নিয়ে লাভ নেই। কতদিন সেখানে থাকব, জানি না। গুরুদেব হয়তো কনখল কি উত্তরকাশীর আশ্রমে পাঠিয়ে দেবেন। তেমন বুঝলে আমিই তোমাদের চিঠি লিখব।
বিনয় বাবাকে লক্ষ করছিল। মনে হল, অবনীমোহন তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে চান, চিরতরে। ঠিকানা না দেবার কারণ সেটাই। তাছাড়া তার ধারণা, বাবা বললেন বটে, কিন্তু কোনওদিনই হয়তো চিঠি লিখবেন না।
ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছিল। অবনীমোহন বললেন, আর বসে থেকো না, তোমরা গাড়ি থেকে নেমে যাও।
প্ল্যাটফর্মে নেমে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। বিষণ্ণ। নীরব। চোখেমুখে সীমাহীন ব্যাকুলতা।
একসময় গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। কয়লার ইঞ্জিন তীক্ষ্ণ সিটি বাজিয়ে সারা স্টেশন চকিত– করে স্টার্ট দিল। ধীর গতিতে বিশাল সরীসৃপের মতো ট্রেনটা প্ল্যাটফর্ম পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।
যতক্ষণ অবনীমোহনকে দেখা যায়, হাত নাড়তে থাকে সুধারা। অবনীমোহনও জানালার পাশে বসে হাত নাড়ছিলেন। খানিক পরে দূরে সবুজ আলো জ্বালিয়ে যে ডিসটান্ট সিগনালগুলো নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর পাশ দিয়ে ট্রেনটা অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল। অবনীমোহনের জীবনের নানা পর্ব শেষ। এবার অন্তিম পর্বের দিকে তাঁর চিরতরে প্রস্থান।
ট্রেন মিলিয়ে যাবার পরও প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিনয়রা। তারপর ভারী গলায় হিরণ বলল, এবার ফেরা যাক।
আগেই ঠিক করা আছে, স্টেশন থেকেই হিরণ আর সুধা বিনয়কে সোজা তাদের টালিগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে যাবে। আনন্দ আর সুনীতি চলে যাবে বিডন স্ট্রিটে।
স্টেশনের ঠিক বাইরে একধারে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। তার গা ঘেঁষে আলাদা আলাদা ঘোড়ার গাড়ি আর রিকশার জটলা।
আনন্দ সুধাদের বলল, তোমাদের অনেক দূর যেতে হবে। একটা ট্যাক্সি নাও। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে।
হিরণ বলল, তাই ভেবে রেখেছি। আপনারা?
আমরা ঘোড়ার গাড়ি নেব। হ্যারিসন রোড আর সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে গেলে বিডন স্ট্রিটে। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। চল, আগে তোমাদের ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই ।
স্ট্যান্ডে লাইন দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল। তার একটায় সুধাদের তুলে দিয়ে বিব্রতভাবে আনন্দ বলল, বিনু, বলার মুখ নেই তবু একটা অনুরোধ করছি। যদি কখনও তোমার ইচ্ছে হয়, আমাদের বাড়ি চলে এস।
বিনয় উত্তর দিল না। আনন্দকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে, ওদের বাড়িতে আর কখনও যাবে না। সেই সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি বদলাবার কোনও কারণ নেই।
ট্যাক্সি ছেড়ে দিলে আনন্দরা ঘোড়ার গাড়ির আস্তানার দিকে চলে গেল।
.
০৯.
এবার সুধাদের বাড়ি আসার পর বিনয়ের কোনও ব্যাপারেই যেন চাড় নেই। শরীর আর মন জুড়ে বিচিত্র এক জড়তা। শুধু তা-ই না, সেই সঙ্গে অসীম ক্লান্তি। চরম অবসাদ। মা তো কবেই চলে গেছেন। ঝিনুক নিরুদ্দেশ। এরা দুজনে জীবনের অনেকখানি অংশ ফাঁকা করে দিয়ে গেছে। অবনীমোহনের প্রতি তার প্রবল বিতৃষ্ণা। তবু তিনি হরিদ্বারে চলে যাবার পর আর-এক দিকে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই মানুষটার সঙ্গে অনেকগুলো বছর যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তিনি যে শিরায় স্নায়ুতে, সমস্ত অস্তিত্বে, শত বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন, এখন সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে।
একে একে প্রিয়জনেরা দূরে সরে যাচ্ছে। মা। বাবা। ঝিনুক। বাকি রয়েছে দুই দিদি। কিন্তু তারাও তো অন্যের স্ত্রী। বিনয়ের প্রতি তাদের অপার মায়া, গভীর সহানুভূতি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই, তারাও অনেকটাই পর হয়ে গেছে। সুনীতির মাথার ওপর রয়েছেন হেমনলিনী। তার দাপট, তার কর্তৃত্বের কাছে সারাক্ষণ সে তটস্থ হয়ে থাকে। শ্বশুরবাড়িতে সুনীতির ক্ষমতা আর কতটুকু! ইচ্ছা থাকলেও সে কি ঝিনুককে বাড়িতে রাখতে পেরেছে? সুধা অবশ্য দুহাত দিয়ে ঝিনুককে আগলে রেখেছিল। কিন্তু তার দাদাশ্বশুর আর জেঠশাশুড়ি বাড়িতে থাকলে কতটা কী করতে পারত, বলা মুশকিল। এই যে হিরণরা তাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছে, পাটনা থেকে দ্বারিক দত্তরা ফিরে এলে তারা এটা কতখানি ভাল চোখে দেখবেন, কে জানে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তাদের স্বত্ব বাপের বাড়ির লোকজনদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য অফিসে জয়েন করার পর সাত দিনও সে এখানে থাকবে না। অন্যের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে ভাবলেই ভীষণ অস্বস্তি হয় বিনয়ের।
অবনীমোহন পুরানো সব বন্ধন ছিঁড়ে গুরুর আশ্রমে চলে যাবেন, আগেই তা স্থির হয়ে ছিল। এটা আকস্মিক কোনও ঘটনা নয়। তবু সত্যিই যখন তিনি চলে গেলেন সেই ধাক্কাটা তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে গেছে হিরণ এবং সুধাকেও।
সুধা চিরকালই চুলবুলে। সদা চঞ্চল। সারাক্ষণ চারপাশে কলরোল তুলে হাওয়ায় উড়তে থাকে। হিরণও খুব আমুদে। হাসিখুশি। কখনও কখনও হুল্লোড়বাজ। কিন্তু ওরাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাড়ির আবহাওয়া ম্রিয়মাণ। মলিন। বিষাদ-মাখানো।