বিনয়রা উত্তর দিল না। ছেলেমেয়ে এবং জামাইদের মুখ দেখে অবনীমোহনের মনে হয় না, সুদূর রাজদিয়ার এক টুকরো ভূখণ্ড নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে।
.
০৮.
সেই যে হিমঋতুর এক বিকেলে পারিবারিক সভা বসেছিল, তারপর পলকে যেন চারটি দিন কেটে গেল। এর মধ্যে রাধেশ্যাম জালানের নামে বাড়ি রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। বিনয়ের নামে রাজদিয়ার জমিজমা সম্পর্কে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন অবনীমোহন। তারপরও একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ভবানীপুরের তেতলা বাড়িটা জুড়ে সেকেলে ভারী ভারী প্রচুর আসবাব। সবই মেহগনি কাঠের। কত কাল ধরে কত যত্নে তিনি আর সুরমা এ-সব তৈরি করিয়েছিলেন! কত সুখস্মৃতি যে ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল, সুধা আর সুনীতি ভাগ করে আপাতত আসবাবগুলো নিক। পরে। বিনয় বিয়ে-টিয়ে করে ঘর-সংসার পাতলে সে যদি এইসব খাট আলমারি থেকে কিছু পছন্দ টছন্দ। করে নিতে চায়, দুই বোন তা দিয়ে দেবে।
এই বিলি-ব্যবস্থায় প্রচণ্ড আপত্তি বিনয়ের। বাবার প্রতি তার তীব্র অভিমান। হেমনলিনীর মতো তিনিও ঝিনুকের সঙ্গে যে নির্দয় আচরণ করেছেন তাতে তার কোনও কিছুই সে নেবে না। একটি কপর্দকও নয়। অবশ্য অবনীমোহনের মুখের ওপর সে-কথা না বললেও, সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
সুধা এবং সুনীতিরও প্ৰরল অনিচ্ছা। যে-অবনীমোহন তাদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন তার টাকা পয়সা বা অন্য কোনও কিছুর ভগ্নাংশও তারা ছুঁতে চায় না। তাছাড়া, সুধার ভাড়া বাড়িটা দোতলা হলেও বেশ ছোট। তার নিজেরই নানা জিনিসে বোঝাই। এর ভেতর বড় বড় খাট আলমারি নিয়ে কোথায় তুলবে? সুনীতি অবশ্য সে সমস্যা নেই। তাদের বিশাল বাড়ি। কিন্তু আনন্দ, বিশেষ করে হেমনলিনী চান না, ছেলের শ্বশুরবাড়ির পুরানো, ব্যবহার-করা আসবাব তাঁর বাড়িতে ঢুকুক। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি রাজি হয়েছেন। একতলার দুটো ফাঁকা ঘরে কিছুদিনের জন্য ওগুলো গাদাগাদি করে রাখা হবে। আনন্দদের বাড়িতে মালপত্র পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।
.
যাবতীয় আয়োজন শেষ। খগেন এবং অবনীমোহনের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। আজ তারা সন্ধের ট্রেনে হরিদ্বার চলে যাবেন।
বিনয় আপাতত ভবানীপুরের বাড়িতেই আছে। বিকেলে আনন্দ সুনীতি সুধা আর হিরণ চলে এল। তারা সবাই অবনীমোহনের সঙ্গে হাওড়ায় গিয়ে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে। অবনীমোহনের ইচ্ছা ছিল না। কষ্ট করে কারও স্টেশনে যাবার দরকার নেই। কিন্তু তার আপত্তিতে কেউ কান দেয়নি।
রাধেশ্যাম জালানকে আসতে বলেছিলেন অবনীমোহন। তিনিও এসে গেছেন। বাড়ির চাবি তার হাতে দিয়ে খগেনকে দিয়ে দুটো ট্যাক্সি ডাকানো হল। মালপত্র সামান্যই। একটা মাঝারি চামড়ার সুটকেসে অবনীমোহনের খানকতক জামাকাপড়, কটি ধর্মগ্রন্থ এবং টুকিটাকি ছোটখাটো জিনিস। আর আছে হোল্ড-অলে বাঁধা বিছানা। খগেনেরও গোটা দুই পুঁটলি হয়েছে। সব একটা ট্যাক্সির ডিকিতে ভরা হলে সেটায় উঠলেন অবনীমোহন। পেছনের সিটে তার দুপাশে বসেছে সুধা আর সুনীতি। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বিনয়। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটায় আনন্দ, হিরণ এবং খগেন।
ছেলেবেলা থেকেই সুধার বড় বেশি আবেগ। অবনীমোহন সব মায়া, সব বন্ধনের গিটগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে চিরকালের মতো চলে যাচ্ছেন। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকে অঝোরে কেঁদে চলেছে সুধা। কান্নার দমকে সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বুক। সুনীতির স্বভাবটা চাপা ধরনের। সেও কাঁদছে, কিন্তু শব্দহীন। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, টকটকে লাল এবং সজল।
বিনয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। নিমেষের জন্যও পেছন ফিরে দেখছিল না। অবনীমোহনের প্রতি তার সুতীব্র ক্ষোভ। বুকের ভেতর কত যে অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে-সব উধাও। জগতে এই মানুষটির সঙ্গে তার সম্পর্ক সব চেয়ে নিবিড়। এরই রক্ত তার শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে। এরকম নিকটজন আরও একজন ছিলেনমা। তিনি তো রাজদিয়ায় চিতাভস্মে কবেই বিলীন হয়ে গেছেন। বাবার সঙ্গে এ-জীবনে আর হয়তো কখনও দেখা হবে না।
বিনয় পুরুষমানুষ। সুধার মতো হাউ হাউ করে কাঁদতে পারে না। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে প্রাণপণে সেটা রুখে দিচ্ছিল সে।
অবনীমোহন মেরুদণ্ড টান টান করে স্থির হয়ে বসে আছেন। চিরবিদায়ের আগে মেয়েদের কান্না বা বিনয়ের থমথমে চেহারা তাকে কতখানি চঞ্চল করেছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। আবেগহীন সুরে মাঝে মাঝে তিনি বলে উঠছেন, কেঁদো না, কেঁদো না।
পৌনে ছটায় ট্রেন। মিনিট কুড়ি আগেই হাওড়ায় পৌঁছে গেলেন অবনীমোহনরা। রিজার্ভ করা বার্থ খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না।
সুধা-সুনীতি হোল্ড-অল খুলে যত্ন করে বিছানা পেতে অবনীমোহনকে বসালো। হিরণ আর আনন্দ তার সুটকেস এবং অন্য টুকিটাকি জিনিস বাঙ্কে রেখে দিল।
অবনীমোহনের সামনের বার্থটা খগেনের। সে তার পোঁটলা দুটো বাঙ্কের মাথায় রেখে একধারে দাঁড়িয়ে আছে। সুধারা তার বার্থে বসে পড়ল।
ধরা ধরা গলায় সুনীতি খগেনকে বলল, তুমি তো বাবার সঙ্গে থাকবে
খগেন ঘাড় কাত করল, হ্যাঁ বড়দি