ছোটদির কথার জবাব দেয় না বিনয়। নীরব থেকে বুঝিয়ে দিল সুধাদের কাছে থাকতে তার আপত্তি নেই। সেখানে সে স্বাচ্ছন্দ্যই বোধ করবে। দিবারাত্রি হেমনলিনীর মুখ অন্তত দেখতে হবে না। তবু একটু দ্বিধা সূক্ষ্মভাবে মাথার ভেতর কোথায় যেন খোঁচা দিতে থাকে। সুধারা খুব যত্ন করেই তাদের কাছে রাখবে। কিন্তু চিরকাল তত বোন-ভগ্নীপতির বাড়িতে থাকা যায় না। সে ভেবে নিল, অবনীমোহন চলে যাবার পর আপাতত কিছুদিন সুধাদের কাছেই কাটাবে। তারপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলাদা ব্যবস্থা করে নেবে।
ঘরের ভেতর নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল।
এবার অবনীমোহন বললেন, তখন ওই তেত্রিশ হাজার টাকার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে অন্য কথা এসে গেল। তোমরা কেউ তো টাকাটা নিতে রাজি না। কিন্তু ওটার বন্দোবস্ত করা দরকার। আমি একটা কথা ভেবেছি।
কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।
অবনীমোহন থামেননি, এখন হয়তো তোমাদের আপত্তি রয়েছে। পরে মত বদলেও যেতে পারে। চিন্তা করে দেখলাম টাকাটা তোমাদের তিনজনের নামে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে যাব। পরে তোমরা যা ভাল বুঝবে তা-ই কোরো।
আনন্দ নিচু গলায় বলল, ঠিক আছে, আপনার যখন সেরকম ইচ্ছে তাই করুন।
অবনীমোহন বললেন, আমার আরও কিছু কথা আছে।
বলুন–
তোমরা জানো, যুদ্ধের আমলে রাজদিয়ায় মজিদ মিঞার কাছ থেকে তিরিশ কানি ধান-জমি কিনে চাষবাস শুরু করেছিলাম। তারপর তো কনট্রাক্টরি করতে আসামে গেলাম। সুধা-সুনীতির বিয়ের সময় মাঝখানে একবারই মাত্র রাজদিয়ায় যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ থামলে সোজা চলে এলাম কলকাতায়
অবনীমোহনের বক্তব্য ঠিক ধরতে পারছিল না আনন্দরা। তারা তাকিয়েই থাকে।
অবনীমোহন সবিস্তার জানালেন, কবছর আসামে এবং পরে কলকাতায় কাটানোর কারণে রাজদিয়ার জমিজমা কী অবস্থায় আছে, সে-সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নেই। তাছাড়া যৌবনের শুরু থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে একবার এদিকে একবার সেদিকে দৌড়তে দৌড়তে হঠাৎ গতিপথ পুরোপুরি বদলে গেল। জীবনে কত কী-ই তো করেছেন! অধ্যাপনা। ব্যবসা। কন্ট্রাক্টরি। চাষবাস। কিন্তু কোনও কিছুই দীর্ঘকাল তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে সেটা, সেটা ছেড়ে অন্য একটা এভাবেই কেটে গেছে জীবনের বেশির ভাগটাই। লম্বা দৌড়ের পর পরমায়ুর শেষ মাথায় পৌঁছে স্থিত হয়েছেন অবনীমোহন। এখন তার একটাই পথ, একটাই গন্তব্য। ধর্ম, গুরুদেব এবং তার আশ্রম। গৃহী জীবনের সমস্ত চিন্তা পেছনে ফেলে তিনি কলকাতা থেকে চলে যেতে চান। বাড়ি বিক্রি, ঋণশোধ–সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে। বিনয় চাকরি পেয়েছে। সেদিক থেকে তার দুর্ভাবনার অবসান ঘটেছে। বাকি শুধু রাজদিয়ার ওই তিরিশ কানি জমি।
অবনীমোহন বিনয়কে জিজ্ঞেস করলেন, আমি আসামে চলে যাবার পর আমাদের জমিগুলো কি এমনিই পড়ে থাকত?
বিনয় বলল, না, তোক দিয়ে নিজের জমিজমার সঙ্গে দাদু ওগুলোও চাষ করাতেন। এ কবছর ধান-পাট বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা পাওয়া গেছে। সে-সব দাদুর কাছে আছে।
পাকিস্তানে যা চলছে ওই টাকা ইন্ডিয়ায় নিয়ে আসা এখন অসম্ভব। সে যাক, আমি অন্য একটা কথা ভাবছিলাম।
বিনয় দুচোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায়।
অবনীমোহন বললেন, জমিগুলোর দলিল টলিল কার কাছে রয়েছে? তুই কি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিস?
না। ওগুলো দাদুর কাছেই আছে। বিনয় জানায়, যে অবস্থায় তাকে পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, দলিলের কথা তখন মাথায় আসেনি। হেমনাথও সেই সময় এমনই বিচলিত, এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত যে অন্য কোনও দিকে তার লক্ষ্য ছিল না। সীমান্ত পেরিয়ে ঝিনুককে নিয়ে নিরাপদে কীভাবে ঘাতকবাহিনীর নজর এড়িয়ে বিনয় ইন্ডিয়ায় পৌঁছবে, সেটাই ছিল একমাত্র চিন্তা। যদি মনে করে হেমনাথ জমিজমার দলিলগুলো সঙ্গে দিতেন, বিপদ শতগুণ বেড়ে যেত। কেননা, পাকিস্তান বর্ডারে ওগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হতো।
অবনীমোহন স্বস্তিবোধ করেন, মামাবাবুর কাছে রয়েছে। এ একরকম ভালই হয়েছে। পাকিস্তানে যা চলছে, দলিল কেড়ে নিলে জমিগুলো খুব সম্ভব হাতছাড়া হয়ে যেত। একটু থেমে বললেন, খবরের কাগজে পড়ি, গায়ের জোরে ওখানে মাইনোরিটিদের প্রপার্টি দখল করে নেওয়া হচ্ছে। দলিলগুলো আছে, এটুকুই যা সান্ত্বনা।
বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে অনেক আগেই যিনি মোহমুক্ত হয়েছেন, গৃহী জীবনের সমস্ত স্মৃতি পেছনে ফেলে যিনি চিরকালের মতো গুরুর আশ্রমে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের কয়েক কানি জমির ব্যাপারে তিনি যে কেন এত চিন্তিত, কারণটা ঠিক ধরা যাচ্ছে না।
অবনীমোহন অবশ্য সব বিশদ করে বুঝিয়ে দিলেন। আপাতত রাজদিয়ার জমিগুলো হেমনাথের রক্ষণাবেক্ষণে যেমন আছে তেমনই থাক। পরে পাকিস্তানের অবস্থা যদি আদৌ ফেরে, সুদিন আসে, বিনয়, হিরণ এবং আনন্দ দেশে গিয়ে বা হেমনাথকে চিঠি লিখে তার পরামর্শমতো ওগুলোর ব্যবস্থা। করতে পারে। অবনীমোহন বলতে লাগলেন, তিনজনের পক্ষে একসঙ্গে যদি যাওয়া সম্ভব না হয়, আমি এমনভাবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যাব, যাতে যে-কেউ গিয়ে জমি বিক্রি করে আসতে পারবে। অবশ্য এতে পাকিস্তানে কাজ হবে কি না জানি না। তবে একটা কথা মনে রেখো, কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে রাজদিয়ায় যাবে না।