তবু বাবার কাছে না গিয়ে উপায় নেই। উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে বাড়ি ফিরে এল বিনয়। একসঙ্গে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকে তেতলায় সোজা অবনীমোহনের ঘরে। সমানে হাঁপাচ্ছে। ভেতরে যে উথালপাতাল ভাবটা চলছে, হাড়পাঁজর ভেদ করে তা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অবনীমোহন খাটের ওপর বালিশে ভর দিয়ে একটা বিশাল বইয়ের ভেতর ডুবে ছিলেন। নিশ্চয়ই কোনও ধর্মগ্রন্থ। খুব সম্ভব হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মশাই মূল মহাভারতের বাংলা যে অনুবাদ করেছেন তার কোনও একটি খণ্ড।
পায়ের আওয়াজে মুখ তুললেন অবনীমোহন। ছেলের মুখচোখ লক্ষ করে তার মনে হল, অঘটন কিছু ঘটেছে। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বিনু?
উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় বিনয়ের কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঝাপসা গলায় কোনওরকমে বলতে পারল, ঝিনুককে পাওয়া যাচ্ছে না।
হাতের বইটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বসলেন অবনীমোহন, সে কী! কোথায় যাবে সে! এত বড় বাড়ি। দেখ, কোনও ঘরে নিশ্চয়ই আছে।
একতলা থেকে তেতলার প্রতিটি কামরা, অলিন্দ, প্যাসেজ, ছাদ, সব আঁতিপাঁতি করে খুঁজে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তো বটেই, এমনকি ট্রামরাস্তা অবধি ছুটে গিয়েছিল বিনয়। সবিস্তার সমস্ত জানিয়ে সে বলল, কোথাও নেই ঝিনুক।
আশ্চর্য! অবনীমোহন যেন থই পাচ্ছেন না, এমন সুরে বললেন, কী এমন ঘটেছে যে কারওকে না জানিয়ে চলে গেল!
বিনয় উত্তর দিল না।
অবনীমোহন এবার বললেন, তুই কি ওকে কিছু বলেছিস?
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। বিনয় হয়তো তার সঙ্গে এমন কোনও আচরণ করেছে যাতে মেয়েটা ক্ষোভে, বেদনায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তার বলতে ইচ্ছা হল, যে-মেয়েকে বুকের ভেতর পুরে পাকিস্তানের সীমানা পার করে নিয়ে এসেছে তাকে এতটুকু আঘাত কি সে দিতে পারে? বিমূঢ়ের মতো বাবার মুখের দিকে তাকালো বিনয়। বলল, তখন তোমার ঘর থেকে বেরুবার পর ঝিনুকের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। তাকে কিছু বলার প্রশ্নই নেই।
লহমায় বদলে গেলেন অবনীমোহন। তড়িৎস্পৃষ্টের মতো তাঁর শরীর বেঁকে দুমড়ে যেতে লাগল যেন। রক্তের ভেতর আগুনের হলকা ছুটছে। কাঁপা গলায় বললেন, তবে কি, তবে কি, ওকে হোমে পাঠাবার যে কথাগুলো তোকে বলেছিলাম, ঝিনুক তা শুনে ফেলেছে?
বিনয়ের অনুমানও ঠিক তা-ই। সে চুপ করে রইল।
অবনীমোহনের আক্ষেপ থামেনি, মেয়েটার হয়তো আর-এক বার সর্বনাশই করে ফেললাম। এত বড় শহরে কোথায় যাবে সে, কোন বদ লোকের পাল্লায় পড়বে, কিছুই বুঝতে পারছি না।
বাবার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে বিনয়। নিরাসক্ত মানুষটিকে ভীষণ বিচলিত মনে হচ্ছে। সংসারের যাবতীয় বন্ধন যিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন, সুখ দুঃখ মায়া মোহ কিছুই যাঁকে স্পর্শ করে না, সেই অবনীমোহন একেবারে বদলে গেছেন। অনুতপ্ত। তীব্র মনস্তাপ তাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে।
খাট থেকে দ্রুত নেমে অবনীমোহন বললেন, চল আমার সঙ্গে
বিনয় রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
থানায়।
থানায় কেন?
এখানকার ওসির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আমাদের পক্ষে কতটুকু কী-ই বা করা সম্ভব? পারলে পুলিশই ঝিনুককে খুঁজে বার করতে পারবে। চল–
যা পরে ছিলেন, সেই পোশাকেই বিনয়কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লেন অবনীমোহন।
.
থানা খুব দূরে নয়। বাড়ি থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক লাগে।
গম্ভীর, ভীতিকর চেহারা নিয়ে থানার মস্ত লাল ইমারত দাঁড়িয়ে আছে। গেটের মুখে বন্দুকধারী, ধড়াচুড়ো-পরা, হিন্দুস্থানী সেন্ট্রি। প্রকাণ্ড চেহারা, জমকালো গালপাট্টা। তাকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, ওসি তার কামরাতেই আছেন।
ভারী ভারী সেকেলে আলমারি, ভারী ভারী টেবল চেয়ার, টেবলে স্তূপাকার ফাইল, কালো রঙের টেলিফোন ইত্যাদি দিয়ে জবরজং সাজানো একটা বড় কামরায় বাবার পিছু পিছু এসে ঢুকল বিনয়।
টেবলের ওধারে যিনি বসে ছিলেন তাঁর বয়স বাহান্ন তিপ্পান্ন। কোঁকড়া চুল, নিখুঁত কামানো লম্বাটে মুখ, গায়ের রং বেশ ফর্সা। চোখের দৃষ্টি শান্ত এবং গভীর। এই বয়সেও মেদ জমেনি। বেতের মতো ছিপছিপে শরীর। দারোগা বলতে যে রুক্ষ রাগী কর্কশ মুখের ছবিটি ফুটে ওঠে তার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। দুর্গের মতো একটা দমবন্ধকরা পরিবেশে তাঁকে যেন ঠিক মানায় না।
ওসি বললেন, আসুন আসুন অবনীবাবু। বসুন অবনীমোহনরা বসলে জিজ্ঞেস করলেন, অনেকদিন পর আপনাকে দেখলাম। শুনেছিলাম, আপনি হরিদ্বার উত্তরকাশী না কনখল, কোথায় যেন গেছেন। আপনার গুরুদেবের কাছে কি?
বিনয় অনুমান করল, অবনীমোহন সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন ওসি। তার গতিবিধিও ওঁর অজানা নয়।
অবনীমোহন মৃদু হাসলেন, গুরু এবং তীর্থদর্শন দুটোই সেরে এলাম। মাসখানেকের ভেতর আবার গুরুর আশ্রমে ফিরে যাব।
মজার সুরে ওসি বললেন, আপনার মতো সাধুসন্ন্যাসী মানুষ হঠাৎ এই পাপীতাপীদের আখড়ায়? কোনও দরকার আছে?
হ্যাঁ।
বিনয় সম্পর্কে ওসির কৌতূহল হচ্ছিল। বার বার তার চোখ সেদিকে চলে যাচ্ছে। বললেন, দরকারের কথা পরে শুনছি। বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, এটি কে? চিনতে পারলাম না তো।
আমার ছেলে। দিনকয়েক হল পাকিস্তান থেকে এপারে চলে এসেছে। ওসির সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন অবনীমোহন। তার নাম দিবাকর পালিত।