আনন্দদা আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছেন। আশা করি, তাতেই চলে যাবে। ওই তেত্রিশ হাজার না পেলেও অসুবিধেয় পড়ব না।
বিনয় তার সংকল্পে এতটাই অনড় যে কী বলবেন, অবনীমোহন ঠিক করে উঠতে পারলেন না।
সুধা হঠাৎ বলে ওঠে, বাবা, তুমি তো বাড়ি বেচে চলে যাচ্ছ। বিনু কোথায় থাকবে?
অবনীমোহনের উত্তর দেওয়া হল না। দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন, ভেতরে আসতে পারি?
অবনীমোহন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আসুন, আসুন– বিনয়ের পাশে যে ফাঁকা চেয়ারগুলো পড়ে ছিল সেখানে তাদের বসানো হল। একজন বেশ লম্বা, ধারালো ফলার মতো মেদহীন স্বাস্থ্য। রীতিমতো সুপুরুষ। পরনে নিখুঁত বিলেতি স্যুট। তার সঙ্গীটির উচ্চতা মাঝারি। ভারী চেহারা। গোলাকার মুখ, শরীরে প্রচুর অনাবশ্যক চর্বি। পরনে ধুতি, সার্জের পাঞ্জাবির ওপর গলাবন্ধ লং কোট, মাথায় পাগড়ি। কপালে এবং কানের লতিতে চন্দনের বড় টিপ। ধুতি পরার ধরন, চন্দন এবং পাগড়ি চিনিয়ে দেয়, লোকটা মারোয়াড়ি।
অবনীমোহন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্যুট-পরাটি হাইকোর্টের নাম করা অ্যাডভোকেট। নাম অজিতেশ লাহিড়ি। তিনিই বাড়ি বিক্রির দলিল তৈরি এবং রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা করবেন। ধুতিওল্লা রাধেশ্যাম জালান। বড়বাজারে তার গদি। নানা ধরনের ব্যবসা করেন। যেটুকু আন্দাজ করা গেল, লোকটার অঢেল টাকা।
অজিতেশ জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ি বিক্রির বিষয়ে আপনার ছেলেমেয়ে জামাইদের মতামত নিয়েছেন?
রাধেশ্যামরা কয়েক পুরুষ কলকাতার বাসিন্দা। সামান্য টান থাকলেও বাংলাটা নির্ভুল বলেন। তারও একই জিজ্ঞাস্য, ছেলেমেয়েরা খুশি মনে বাড়ি বিক্রিতে রাজি হয়েছে কি না। বাবার সিদ্ধান্তের জন্য পরে যেন তারা আপশোষ না করে। কারও মনে দুঃখ দিয়ে তিনি সম্পত্তি খরিদ করতে চান না।
অবনীমোহন বললেন, না, কারও কোনও আপত্তি নেই। ওদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। লাহিড়ি সাহেব আপনি দলিল তৈরি করুন। রাধেশ্যামজি, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।
রাধেশ্যাম বললেন, হাঁ হাঁ, বলুন কী অনুরোধ।
দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেই আমি চলে যাব। আমার ছেলে বিনুর কথা আপনাকে সবই বলেছি। সবে পাকিস্তান থেকে এসেছে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত দয়া করে যদি ওকে কিছুদিন এখানে থাকতে দেন–
যতদিন ইচ্ছা ছোটবাবুজি এ-বাড়িতে থাকবেন। এক বছর, দুবছর–আমার আপত্তি নেই।
অবনীমোহন বললেন, কী বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা– তার কথা শেষ হবার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বিনয়, না না, বাবা চলে গেলে আমি আর এক মুহূর্তও এ-বাড়িতে থাকব না। নিজের বাবাই যখন ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন, অনাত্মীয়, অচেনা একটা মানুষের করুণা তার প্রয়োজন নেই।
ঘরের ভেতর অপার স্তব্ধতা নেমে আসে। সবাই ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছিল। একসময় রাধেশ্যাম বললেন, ঠিক আছে ছোটবাবুজি, আপনার যেমন ইচ্ছা। এখন চলি– তিনি উঠে পড়লেন।
দেখাদেখি অজিতেশ লাহিড়িও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রাধেশ্যাম জালান এবং অজিতেশ লাহিড়ি চলে যাবার পর বিব্রতভাবে অবনীমোহন বললেন,একটা ব্যবস্থা করেছিলাম, তুই রাজি হলি না। আমি আর কদিনই বা কলকাতায় আছি। তারপর কোথায় থাকবি?
বিনয় রুক্ষ স্বরে বলতে যাচ্ছিল, তার সম্বন্ধে অবনীমোহনকে চিন্তা করতে হবে না। ধর্মকর্ম আর গুরুদেব নিয়ে যিনি মত্ত, অন্যের দুঃখ কষ্ট, সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তার বিচলিত না হলেও চলবে। কিন্তু কী ভেবে থমকে গেল। উদাসীন মুখে শুধু বলল, দেখি—
হঠাৎ আনন্দ বলে ওঠে, এই নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। বিনু আমাদের কাছে থাকবে। বিডন স্ট্রিট থেকে ওর অফিস খুব দূরে নয়, হেঁটেই চলে যাওয়া যায়।
চকিতে হেমনলিনীর চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কী নিষ্ঠুরভাবেই না ওই মহিলা একরকম গলাধাক্কা দিয়ে ঝিনুককে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে যে কী মানসিক পীড়ন! ঝিনুকের সেই চরম লাঞ্ছনা এবং অপমান এই তো সেদিনের ঘটনা। পলকের জন্যও সে-সব ভুলতে পারে না বিনয়। সারাক্ষণ সেগুলো তার মাথায় যেন শেল বেঁধাতে থাকে। মুখ কঠোর হয়ে ওঠে তার। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলে, আপনাদের বাড়িতে থাকার কথা বলবেন না আনন্দদা। আমি ওখানে কিছুতেই যাব না।
বিনয়ের অনিচ্ছার কারণটা বুঝতে পারে আনন্দ। ঝিনুকের অসম্মানে সবচেয়ে বেশি ক্লেশ আর যাতনা যে ভোগ করেছে সে বিনয়। মুখ কালো হয়ে যায় আনন্দর। কিছু একটা উত্তর দিতে চেষ্টা করে কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।
আনন্দর ডান পাশে ছিল সুনীতি। ঝিনুকের প্রতি হেমনলিনীর আচরণে সেও কম কষ্ট পায়নি। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার বিনয়ের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। সে জানে তার এই ভাইটি ভীষণ জেদি। শত অনুরোধেও সে তার শ্বশুরবাড়িতে আর কখনও যাবে না।
বিনয়ের গা ঘেঁষে বসে ছিল সুধা। সে বলল, ঠিক আছে, বিনুকে আমার কাছেই নিয়ে যাব।
ছোটদি আর হিরণের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই বিনয়ের। অপার মমতায় ওরা ঝিনুককে কাছে টেনে নিয়েছিল। লাঞ্ছিত মেয়েটা ভয়ে গ্লানিতে আতঙ্কে কুঁকড়ে থাকত। সুধাদের কাছে এসে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল সে। কতকাল পর সহজভাবে শ্বাস নিতে পারছিল। ত্রাসের বেড়াজাল ছিঁড়ে খুশিতে তখন সে ভরপুর। চঞ্চল পাখির মতো তখন সে ডানা মেলতে শুরু করেছে। সারাক্ষণ তার কলকলানি, গান বাজনা সিনেমা থিয়েটার–সব ব্যাপারেই তার অফুরান কৌতূহল, অনন্ত প্রশ্ন। তার ভয়ার্ত মলিন মুখে ফিরে এসেছিল ঝলমলে হাসি। কত যত্নে, কত মায়ায় সুধারা ঝিনুকের দুঃখের স্মৃতিগুলোকে যে মুছে দিয়েছিল।