চমকে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বিনয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে খগেন। সামনের দেওয়ালের দিকে বিনয়ের নজর চলে যায়। ওয়েস্ট-এন্ড ওয়াচ কোম্পানির একটা গোলাকার ঘড়ি সেখানে আটকানো। এখন একটা বেজে তেত্রিশ।
বিনয় একটু লজ্জা পেল। কেননা তার খাওয়া না হলে খগেন খাবে না। তার জন্যই লোকটা এত বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। খাট থেকে নামতে নামতে ব্যস্তভাবে সে বলল, তুমি যাও। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর চলে আসছি। একটা ঘরে-পরার পাজামা আর শার্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।
গুরুদেবের কাছে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ আহার শুরু করেছেন অবনীমোহন। এ-বাড়িতে এসে তা-ই খাচ্ছে বিনয়। তার জন্য আলাদা করে মাছ মাংসের ব্যবস্থা হোক, এটা সে চায়নি। খগেনের বাড়তি খাটনি হবে, ভাবতে সঙ্কোচ হয়েছে।
বিনয়ের মনে হয়, এখানে সে যেন একজন উটকো অতিথি। কেউ তাকে ডেকে আনেনি, নিজের থেকেই এসে হাজির হয়েছে। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর কদিন একটু বিচলিত হয়েছিলেন অবনীমোহন। বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে থানায় পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর আবার যে-কে সে-ই। আগের মতোই নিরাসক্ত। পার্থিব সমস্ত ব্যাপারেই উদাসীন। নিজের চারপাশে শক্ত একটা বলয়। তৈরি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। বিনয় কী খাচ্ছে না খাচ্ছে, তার কোনওরকম অসুবিধা হচ্ছে কিনা, এ-সব নিয়ে খোঁজটোজও নেন না।
স্নান সেরে একতলা থেকে খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে ফের নিজের ঘরে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল বিনয়। দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই তার। ঘড়ির কাঁটা আজ বড় বেশি মন্থর। সময় যেন কাটতেই চায় না। বিছানায় ছটফট করতে লাগল সে।
.
০৭.
কখন সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিল, কখন বাতাসে হিম মিশতে শুরু করেছে আর কখনই বা রোদ ঝলমলে ভাবটা হারিয়ে মলিন হয়ে গেছে, বিনয় খেয়াল করেনি।
খগেন এসে আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলল, সব্বাই বড়বাবুর ঘরে এসি গেচেন, আপনারে যেতি বললেন–
যাচ্ছি
তেতলায় এসে বিনয় দেখতে পেল, অবনীমোহন যথারীতি তার খাটে বসে আছেন। কাছাকাছি মেঝেতে খানকয়েক চেয়ার সাজানো রয়েছে। সেখানে বসে আছে সুধা হিরণ সুনীতি এবং আনন্দ। কয়েকটা চেয়ার এখনও ফাঁকা।
বিনয় দোতলায় যে ঘরখানায় থাকে সেখান থেকে ওপরে-নিচে ওঠানামার সিঁড়ি চোখে পড়ে না। তাই কখন সুধা সুনীতিরা তেতলায় উঠে এসেছে, সে টের পায়নি। ফাঁকা চেয়ারগুলোর একটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে অবনীমোহন বিনয়কে বসতে বললেন। নীরবে বসে পড়ল সে। ওবেলা অবনীমোহন জানিয়েছিলেন তার অ্যাডভোকেট এবং এ-বাড়ি যিনি কিনবেন তাকেও আসতে বলেছেন। কিন্তু এখনও তারা এসে পৌঁছননি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর কী ভেবে অবনীমোহন সুধা সুনীতিদের বললেন, এ-বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত যে আমি নিয়েছি, বিনুকে তা আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আজ এখানে আসার পর তোমাদেরও শুনিয়েছি।
কেউ উত্তর দিল না।
বাড়ি বেচার কারণটা বিনয়কে বিশদভাবে আগেই বার দুই বলেছেন অবনীমোহন। এবার দুই মেয়ে ও দুই জামাইকেও বললেন। অঋণী হয়েই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চান। ঋণগ্রস্ত অবস্থায় মৃত্যুর কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তার কাছে সেটা নরকযন্ত্রণার সমান।
এবারও মেয়ে জামাইরা চুপ করে থাকে।
অবনীমোহন থামেননি, আমার ধারদেনার পরিমাণ বিরাশি হাজার টাকা। এই বাড়ির দাম পাচ্ছি। এক লাখ পনেরো হাজার। ঋণ মিটিয়ে আমার হাতে থাকছে তেত্রিশ হাজার। প্রথমে ভেবেছিলাম, এই টাকা নিয়ে আমি গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব। পরে মত বদলেছি।
খাটের সামনে বসে শ্রোতারা উন্মুখ তাকিয়ে থাকে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, গৃহী জীবনের কোনও কিছু নিয়ে আমি আশ্রমে যেতে চাই না। এখানকার সব পেছনে ফেলে রেখে খালি হাতে চলে যাব। আমার ইচ্ছা, ওই বাড়তি টাকাটা সুধা সুনীতি আর বিনুকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দিই। তোমরা কী বল?
সুধা বলল, ওই টাকার আমার দরকার নেই। আমার ভাগেরটা তুমি বিনুকে দিও।
সুনীতিও তার মনোভাব জানিয়ে দেয়। সেও টাকা নেবে না। তার ভাগেরটাও যেন বিনয়কেই দেওয়া হয়। হিরণ এবং আনন্দর এ-ব্যাপারে আন্তরিক সায় আছে। শ্বশুরের কাছে তাদের আদৌ কোনও প্রত্যাশা নেই। বরং পুরো তেত্রিশ হাজার টাকা পাওয়া গেলে বিনয় অনেকখানি নিশ্চিন্ত হতে পারবে। ওই টাকাটা তার ভবিষ্যতের পক্ষে বড় রকমের বল-ভরসা।
অবনীমোহন খুব সম্ভব খুশিই হলেন। বললেন, বেশ, তা-ই হবে। বিনুর নামে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকাটা আমি জমা করে দেব।
বিনয় বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল। পলকহীন। সে মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না, অবনীমোহনের জন্য ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মেয়েটা আদৌ বেঁচে আছে কি না, কে জানে। যদি বেঁচেও থাকে, তার জীবন আরও গ্লানিকর, আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কি না, কে বলবে। বাবার প্রতি তার কত যে ক্রোধ, কত যে অভিমান, কত যে ক্ষোভ! বিনয় চাপা ধরনের মানুষ। ভেতরে যে তুমুল আলোড়ন চলছে তা ফেটে বেরিয়ে আসতে দেয় না। নীরস গলায় সে বলে, আমি ছোটদি বড়দির ভাগের টাকা চাই না। আমাকে যা দিতে চেয়েছেন তাও নেব না।
অবনীমোহন হকচকিয়ে যান। নম্র, মৃদুভাষী বিনয় যে মুখের ওপর এত স্পষ্ট করে না বলে দিতে পারে, ভাবা যায়নি। বিহুলের মতো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তিনি। ছেলের এই প্রত্যাখ্যান তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। ঢোক গিলে বললেন, টাকাটা নিলে তোর সুবিধে হতো। অর্থ একটা বড় শক্তি।