খগেন মাথা নাড়ে, না।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
খগেন চলে গেল। এবেলা আর বেরুনো হল না। কিছুটা কৌতূহল এবং খানিক সংশয় নিয়ে তেতলায় বাবার ঘরে চলে এল বিনয়।
এর ভেতর স্নান হয়ে গেছে অবনীমোহনের। ভাজকরা ধবধবে থান-ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। তার ওপর খদ্দরের হাফ-হাতা পাঞ্জাবি এবং গরম শাল। বিছানায় শিরদাঁড়া টান টান করে বসে আছেন। সামনে নিচু ডেস্কের ওপর কোনও সগ্রন্থ খোলা রয়েছে। গীতা কিংবা উপনিষদ। খুব সম্ভব সেটাই পড়ছিলেন।
পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন অবনীমোহন। বইটা বন্ধ করে বললেন, ওখান থেকে একটা চেয়ার এনে বোস।
ডানপাশের দেওয়াল ঘেঁষে খানচারেক চেয়ার সারি দিয়ে দাঁড় করানো। তার একটা খাটের কাছে টেনে এনে নিঃশব্দে বসে পড়ল বিনয়।
অবনীমোহন কয়েক পলক ছেলেকে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, শুধু শুধু রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে শরীর নষ্ট করছিস কেন? যে নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে তাকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
বিনয় চমকে উঠল। জাগতিক ব্যাপারে অবনীমোহন তাহলে একেবারে নিস্পৃহ নন। ছেলের গতিবিধির ওপর তার নজর আছে। উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মন খারাপ করে যদি সারাক্ষণ কাটাস, জীবনে দাঁড়াবি কীভাবে? এমন করে চলতে পারে না। ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবতে হবে।
এবারও জবাব দিল না বিনয়।
অবনীমোহন খানিক ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, অফিসে তোকে কবে জয়েন করতে হবে যেন?
বিনয় মনে মনে হিসেব করে বলল, দিনকয়েক পর।
একটু নীরবতা।
তারপর অবনীমোহন বললেন, যদি ঠিক করে থাকিস, এ-বেলা বেরুবি, ঘুরে আয়। ও-বেলা কিন্তু বাড়িতে থাকবি।
বিনয় বলল, কোনও দরকার আছে?
হ্যাঁ। বিকেলে সুধা সুনীতি আনন্দ আর হিরণকে আসতে বলেছি। আমার লইয়ারও আসবেন। আর এই বাড়ি যিনি কিনবেন তিনিও আসছেন। সেইসময় তোর থাকা দরকার।
বিনয় হতচকিত। পাকিস্তান থেকে আসার পর যেদিন অবনীমোহনের সঙ্গে প্রথম দেখা হল তখনই তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাড়িটা বিক্রি করে দেবেন। ব্যবসার জন্য বাজার থেকে প্রচুর লোন নিয়েছিলেন। ব্যবসা ফেল পড়ায় সিকি পয়সাও ফেরত দিতে পারেননি। ঋণের টাকা সুদে আসলে বিপুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ি ছাড়া তার অন্য সম্বল নেই। এটা বেচে তাবৎ ধারদেনা শোধ করতে চান। ঋণমুক্ত হতে না পারলে মরেও তিন স্বস্তি পাবেন না। এ-সব সবিস্তারে বললেও বিনয়ের স্মৃতি থেকে পুরোটাই মুছে গিয়েছিল। ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর সে এমনই দিশেহারা, যে অন্য কিছু ভাবার, অন্য দিকে তাকাবার সময় পায়নি।
এই মুহূর্তে অবনীমোহনের কথা শুনতে শুনতে বিনয়ের মনে হল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙেচুরে খান খান হয়ে নেমে আসছে। বাড়ি বিক্রির তারিখটা যে নিঃশব্দে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, আজ বাবার ঘরে আসার আগে সে টেরও পায়নি। কী বলবে, কী করবে, ভেবে পেল না বিনয়।
অবনীমোহন বললেন, কথা হয়ে গেল। এখন তুই যেতে পারিস।
বিনয় উঠে দাঁড়ালো। তারপর দোতলায় নিজের ঘরটিতে এসে পশ্চিম দিকের চওড়া জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
এখান থেকে খানিক দূরে রসা রোডের একটা অংশ চোখে পড়ে। মহানগরের ব্যস্ততা এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। লোকজন কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ট্রাম বাস এবং অন্য যানবাহনও। ক্কচিৎ জৈদকা কোম্পানির ছাদখোলা দু-একটা দোতলা বাসও। মানুষ বা গাড়িঘোড়া কারওই যেন বিশেষ তাড়া নেই। ঢিলেঢালা, অলস ভঙ্গিতে তারা চলে যাচ্ছে। কাল রাতে ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছিল, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। ভোরের দিকে যে ঠাণ্ডা, হিমেল হাওয়া বইছিল তার তাপাঙ্ক একটু একটু করে বাড়ছে। অনেক উঁচুতে আকাশের নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কটা পাখি উড়ছিল। কী পাখি ওগুলো? কী তাদের নাম? শঙ্খচিল কি?
তাকিয়েই আছে বিনয়। কিন্তু এই টুকরো টুকরো চলমান দৃশ্যাবলী তার মাথায় একেবারেই দাগ কাটছে না। সব কেমন যেন ছাড়া ছাড়া, অসংলগ্ন, অর্থহীন। একে ঝিনুকের চিন্তাটা তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে পাষাণভারের মতো চেপে বসে আছে। তার ওপর আরেকটা সমস্যা বিশাল আকার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। অবনীমোহন এ-বাড়ি বিক্রি করে দিলে কোথায় থাকবে সে? বিনয় জানে, সুধার দরজা চিরকালই তার জন্য খোলা। ঝিনুক নেই, সুনীতিদের কাছে গিয়ে থাকলে হেমনলিনী আপত্তি করবেন না। বরং যথেষ্ট সমাদর করে কাছে টেনে নেবেন। কিন্তু বোনেদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়াটা কি আদৌ সম্মানজনক?
অস্থির, ব্যাকুল বিনয় অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে শুয়ে শূন্য চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সকালটা কখন দুপুর হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা নরম ভাবটা কেটে গিয়ে বোদ কখন ঝকঝকে হয়ে উঠেছে, খেয়াল করেনি বিনয়। সকালের দিকের আলস্য গা থেকে ঝেড়ে ফেলে শহর জুড়ে এখন তুমুল ব্যস্ততা। ট্রাম রাস্তা ধরে উধশ্বাসে ছুটে চলেছে রকমারি যানবাহন। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে নানা ধরনের মিশ্র আওয়াজ। গাড়িঘোড়ার, মানুষের কলরোলের। সবই তীব্র। কর্কশ। চড়া তারে বাঁধা।
হঠাৎ খগেনের গলা কানে এল, দাদাবাবু, অনেক বেলা হয়েছে। চান করে খেয়ে নিন।