বলমাত্র ঢিপ ঢিপ করে তারা প্রণাম সেরে একধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে রইল।
সন্তোষ বললেন, মাসিমা আসেনি?
এসেছে। এই তো আঙুল বাড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িটা দেখালেন আশু দত্ত।
সুরেশদাদাকে দেখছি না তো
গাড়ির ভেতর জড়পিণ্ডের মতো যে বৃদ্ধাটি এক কোণে বসে ছিলেন, আচমকা ক্ষীণ, করুণ সুরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সেই সঙ্গে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য গলায় সুরেশের নাম করে একটানা কী বলে যেতে লাগলেন। তার বিলাপের ধ্বনি কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতটাকে বিষাদে ভরিয়ে তুলল।
সন্তোষ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, কী হয়েছে দাদা? মাসিমা কাঁদছে কেন?
ভারী গলায় আশু দত্ত বললেন, পরে শুনিস।
এরপর গাড়ির দরজা খুলে আশু দত্তর মাকে এবং সীমান্তের ওপার থেকে সামান্য যা জিনিসপত্র আনা সম্ভব হয়েছিল, ধরাধরি করে সব নামানো হল।
সন্তোষ কিশোরী মেয়েটার দিকে ফিরে বললেন, শিগগির তোর মাকে ডেকে আন। মাসিমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে।
মেয়েটা আরে-একবার দৌড়ে চলে গেল। এবার সঙ্গে করে নিয়ে এল কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানা একজন মাঝবয়সী মহিলাকে। আশু দত্তর মা সমানে কেঁদে চলেছেন। সন্তোষের স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরা সযত্নে তাকে ধরে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল।
এদিকে ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান অধৈর্য হয়ে উঠেছিল। সওয়ারিদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এক লহমাও সে আর এখানে নষ্ট করতে রাজি নয়। তাকে ছেড়ে দেবার জন্য সমানে তাড়া দিতে শুরু করেছে।
বিনয় ভাড়া দিতে যাচ্ছিল, এক ধমকে তাকে থামিয়ে আশু দত্ত নিজেই তা মিটিয়ে দিলেন। গাড়ি ধীর চালে বড় রাস্তার দিকে চলতে শুরু করল। একটু পর সামনের একটা বাঁক ঘুরে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিনয় বলল, স্যার, আমি এখন চলি। আপনারা ভীষণ ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন।
এতক্ষণ আশু দত্তদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন সন্তোষ। হঠাৎ বিনয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একে তো চিনতে পারলাম না।
আশু দত্ত বললেন, রাজদিয়ার হেমনাথ মিত্রের নাতি বিনয়। স্কুলে আমার ছাত্র ছিল। তুই তো হেমদাদাকে চিনিস।
চিনব না? কলকাতায় চাকরি পাওয়ার আগে যখন রাজদিয়ায় আপনাদের বাড়ি যেতাম, হেমদাদার সঙ্গে দেখা না করলে খুব অভিমান করতেন। এমন মানুষ হয় না।
শিয়ালদায় ট্রেন থেকে নামার পর তোকে না দেখে কী করব যখন ভেবে পাচ্ছি না তখন বিনয়ের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ও-ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বিনয়ের সঙ্গে দেখা না হলে ভীষণ বিপদে পড়তাম।
সন্তোষ ভাল করে বিনয়কে লক্ষ করলেন। বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট। তাকে আপনি করে না বললেও চলে। বললেন, রাস্তা থেকে চলে যাবে, তাই কখনও হয়। এস
বিনয় বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে। আজ থাক। পরে একদিন আসব।
আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, কবে আসবি?
দুচার দিনের ভেতর।
আসবি কিন্তু। তোর সঙ্গে অনেক দরকারি কথা আছে।
আচ্ছা
বিনয় আর দাঁড়ালো না। সরু গলিটা ধরে বড় রাস্তার দিকে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। সেখান থেকে ট্রাম বাস, কিছু একটা ধরে সোজা ভবানীপুর যাবে।
০৬-১০. ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট
০৬.
ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আশু দত্তদের সেই যে বিনয় পৌঁছে দিয়ে এসেছিল, তারপর দুটো দিন পেরিয়ে গেল।
সুবিশাল এই মহানগরের জনারণ্যে ঝিনুক হারিয়ে গেছে। বিনয় প্রায় নিশ্চিত, তাকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু বুকের ভেতরে অদৃশ্য কোনও কুঠুরিতে অতি ক্ষীণ একটু আশা এখনও ধুকপুক করে। তাই সকাল হলেই চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। ট্রাম রাস্তা, বাস রাস্তা ছাড়াও সরু সরু অলিগলিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়। চারপাশের প্রতিটি মানুষকে লক্ষ করে, যদি অলৌকিক কোনও ভোজবাজিতে ঝিনুকের দেখা মেলে। তারপর চলে যায় থানায়। থানা থেকে ফিরে কোনওরকমে চান-খাওয়া সেরে মুহ্যমানের মতো কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে। বেলা একটু পড়লে আবার রাস্তায় রাস্তায় ছোটাছুটি। খোঁজাখুঁজি।
এই দুদিনও তার হেরফের ঘটেনি। কিন্তু বৃথাই এই অনুসন্ধান। রাত্রিবেলা যখন সে বাড়ি ফেরে তার যাবতীয় উদ্যম আর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, হতোদ্যম বিনয়কে দেখলে তখন কষ্টই হয়।
.
আজও সকালে চা খাওয়া শেষ হলে ঘর থেকে বেরুতে যাবে, বাধা পড়ল। দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খগেন। সে ডাকল, দাদাবাবু
মুখ ফিরিয়ে তাকায় বিনয়, কিছু বলবে?
বড়বাবু আপনাকে একবার ওপরে যেতি বলেছেন।
বিনয়ের ঘর দোতলায়। অবনীমোহন থাকেন তেতলায়, মাত্র চোদ্দ ফুট উঁচুতে। একই বাড়িতে কদিন ধরে তারা আছে। কিন্তু দুজনের দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা খুব কমই হয়েছে। অবনীমোহন ভোর থেকে তার জপতপ, পুজো এবং ধর্মগ্রন্থ নিয়ে মগ্ন থাকেন। ইহকালের সুখদুঃখ বা অন্য সব সমস্যা সম্পর্কে তিনি প্রায় উদাসীন। আর বিনয়ের ধ্যানজ্ঞান ঝিনুক। এই মেয়েটার চিন্তায় চিন্তায় সারাক্ষণ সে আচ্ছন্ন। দুজনের কক্ষপথ আলাদা। মাঝখানে লক্ষ কোটি যোজনের ব্যবধান। তারা যেন ভিন্ন দুই গ্রহের মানুষ। পরস্পরের সম্পূর্ণ অচেনা।
এ-বাড়িতে আসার পর নিজের থেকে অবনীমোহন কখনও তাকে ডেকে পাঠাননি। হঠাৎ কী এমন হতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। বেশ অবাকই হল বিনয়। জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছেন, জানো?