বউ ঠাকরুন আর শিবানী দিদি।
এঁরা ছাড়া অন্য কেউ ছিল না?
হেমদাদার তো তিনজনের সংসার। ওঁরা ছাড়া আর কে থাকবে? ও হ্যাঁ, তোদের সেই পুরানো কামলা করিম–তাকেও দেখেছি।
মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে, ঝিনুক রাজদিয়ায় যায়নি। পাকিস্তান থেকে চলে আসার জন্য যে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, আবার সেই হননপুরীতে সে ফিরে যাবে এটা মনে করাই ভুল। তবু ক্ষীণ দুরাশাকে বিনয় প্রশ্রয় দিয়েছে–যদি গিয়ে থাকে? রাজদিয়ায় গেলে হেমনাথ কি আর আশু দত্তকে জানাতেন না? তীব্র হতাশায় ডুবে যেতে থাকে বিনয়।
আশু দত্ত এবার বললেন, হেমদাদা তোদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন। তার বাবার আর দুই দিদির ঠিকানাও দিয়েছেন। শিয়ালদায় নেমে প্রথম দিনই তোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। এতক্ষণ তো আমার কথাই শোনালাম। তোর খবর বল। কী করছিস? কোথায় আছিস?
ঝিনুক রাজদিয়ায় ফেরেনি, সেটা বুঝে যাবার পর ভেতরে ভেতরে একেবারে ভেঙে পড়েছে বিনয়। কথা বলতে ভাল লাগছিল না। তবু বলতে হল। ঝিনুকের ব্যাপারটা গোপন করে বাকিটা ঠিক ঠিক জানিয়ে দিল।
আশু দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, ভবতোষের মেয়ে ঝিনুক তোর সঙ্গে ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল না?
ঝিনুকের নামটা আশু দত্তর মুখ থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর দমাদ্দম হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল বিনয়ের। দাঁতে দাঁত চেপে ঝাপসা গলায় সে বলল, হ্যাঁ, স্যার।
মেয়েটা নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। ওকে যত্ন করিস। দেখিস নতুন করে আর যেন কষ্ট না। পায়।
ঝিনুকের চরম লাঞ্ছনার খবরটা জগৎসংসারে কারও জানতে বাকি নেই। আশু দত্ত রাজদিয়ার মানুষ। তিনি তো জানবেনই।
বিনয় উত্তর দিল না। নীরবে, নতচোখে বসে রইল।
একসময় ঘোড়ার গাড়ি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পৌঁছে যায়।
.
০৫.
রাস্তাটা বেশ সরু। এঁকে বেঁকে, পাক খেতে খেতে, এগিয়ে গেছে। এখানে বেশির ভাগই পুরানো বাড়ি। একতলা, দোতলা। ক্কচিৎ দু-একটা তিনতলা। সবই সাদামাঠা, ছিরিছাঁদহীন। প্রতিটি দালান কোঠার গায়ে মলিন ছাপ। ফাঁকে ফাঁকে টালি বা টিনের চালের ঘর, মাটকোঠা। মনে হয়, আদ্যিকালের কোনও শহরের পথ।
কর্পোরেশনের যে বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে, ঘন কুয়াশা চারপাশ থেকে সেগুলোর দম বন্ধ করে দিচ্ছে। হিমঋতুর এই রাতের সঙ্গে যুঝে যুঝে কোনওরকমে তারা ঝাপসা আলো বিতরণ করে চলেছে।
এখানে প্রচুর দোকানপাট। কোনওটা তেলেভাজার, কোনওটা মুড়িমুড়কি বাতাসা এবং ছোলাভাজার, কোনওটা চায়ের, কোনওটা মুদিখানা। তাছাড়া দুচার পা ফেললেই ছোটখাটো লন্ড্রি, মনিহারি দোকান, মিষ্টির দোকান, সোনারুপোর গয়নার দোকান। এই দোকানগুলোর কটাতেই বা ইলেকট্রিক আলো! হয় কেরোসিনের লম্ফ, হেরিকেন বা লম্বা উঁটিওলা গ্যাসবাতি জ্বলছে।
রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন চোখে পড়ছে। হিমে, কুয়াশায় এবং চতুর্দিকের নিস্তেজ আলোয় মনে হয় ছায়ামূর্তির মিছিল।
নিরুৎসুক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারদিক দেখতে দেখতে আবছাভাবে ভাবল, সে যেন পরিচিত পৃথিবীর বাইরে অচেনা, ভুতুড়ে, অবাস্তব কোনও গ্রহে এসে পড়েছে।
রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে সন্তোষ নাগদের ভাড়া বাড়ির হদিস পেতে অসুবিধা হল না। এই এলাকার অন্য সব বাড়ির মতো সেকেলে ধাঁচের দোতলা। বয়স কম করে ষাট সত্তর বছর তো হবেই। তৈরি হবার পর সেই যে রং করা হয়েছিল, তারপর ওটার গায়ে আর হাত পড়েনি। পলেস্তারা অনেক জায়গায় খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। দেওয়ালের গায়ে শ্যাওলার কালো কালো ছোপ। রেন-ওয়াটার পাইপ ভাঙাচোরা। বন্ধ সদর দরজার মাথায় অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব জ্বলছিল। সেই আলোয় দেখা গেল, কপাটের পাল্লায় চকখড়ি দিয়ে বড় হরফে লেখা : ২৭বি।
ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে বিনয় জোরে জোরে দরজার কড়া নাড়তে লাগল।
একটু পর তেরো চোদ্দ বছরের একটি সুশ্রী কিশোরী দরজা খুলে বলল, কাকে চান? এখানে সন্তোষ নাগরা থাকেন? ঠিকানাটা খুঁজে বার করার পরও পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্নটা করল বিনয়।
হ্যাঁ। আমার বাবা।
তিনি বাড়ি আছেন?
হ্যাঁ।
তাঁকে খবর দাও, পাকিস্তানের রাজদিয়া থেকে তার এক দাদা আশু দত্ত মশাই এসেছেন-
এক্ষুনি বাবাকে ডেকে আনছি।
মেয়েটি এক ছুটে ভেতর দিকে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে যখন ফিরে এল, সঙ্গে একজন প্রৌঢ় এবং আরও তিনটি ছেলেমেয়ে, যাদের বয়স ছয় থেকে দশ এগারোর মধ্যে। অপার কৌতূহল নিয়ে তারা একবার বিনয়, পরক্ষণে ঘোড়ার গাড়ির আরোহীদের লক্ষ করতে লাগল।
প্রৌঢ়টির উচ্চতা মাঝারি। গোলগাল, ভালমানুষ গোছের চেহারা। পরনে আধময়লা ধুতি এবং হাফ শার্টের ওপর চাদর জড়ানো। বিনয় বুঝতে পারছিল, ইনিই আশু দত্তর মাসতুতো ভাই সন্তোষ নাগ।
সন্তোষ ব্যগ্রভাবে বললেন, আশু দাদা কোথায়? আশু দাদা
ঘোড়ার গাড়ি থেকে ততক্ষণে আশু দত্ত নেমে এসেছেন। বললেন, এই যে
পাকিস্তান থেকে আসবেন, আগে জানাননি তো? চিঠি লিখলে শিয়ালদায় চলে যেতাম
বিনয় কলকাতায় পৌঁছে আনন্দ এবং হিরণকে যা বলেছিল, হুবহু তাই বললেন আশু দত্ত। অর্থাৎ চিঠি লিখেছিলেন। হিরণদের মতো একই উত্তর দিলেন সন্তোষ। আশু দত্তর চিঠি তিনি পাননি। সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন, পাকিস্তানের চিঠিপত্র আজকাল নিয়মিত আসছে না। কথা বলতে বলতে নিচু হয়ে আশু দত্তর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সদরের সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলোকে বললেন, ইনি জেঠু। নমো কর ।