পলকহীন প্রাক্তন মাস্টার মশাইটির দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরি রাজদিয়া হাই স্কুলের হেড মাস্টার হলেও প্রবল প্রতাপে স্কুলটা চালাতেন আশু দত্তই। শুধু স্কুল কম্পাউন্ডেই নয়, দাপট ছিল তার সারা রাজদিয়া জুড়ে। সেখানকার প্রতিটি মানুষ তাকে সমীহ করত। এতকাল কী শ্ৰদ্ধাই না তিনি পেয়ে এসেছেন! সেই আশু দত্তকে এখন আর চেনাই যায় না। উদ্বেগে দুর্ভাবনায় তার শক্ত শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে।
জড়সড় বিপর্যস্ত বৃদ্ধটিকে দেখতে দেখতে মায়াই হয় বিনয়ের। চকিতে আর-একজন মাস্টার মশাই জামতলির রামরতন গাঙ্গুলির মুখটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে। শয়ে শয়ে সর্বস্ব হারানো, ভয়ার্ত মানুষের মতো বিনয় আর ঝিনুক ওঁদের সঙ্গে তারপাশা থেকে স্টিমার ধরেছিল। জীবন্ত রামরতন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আসতে পারেননি। এসেছিল তার মৃতদেহ। দুই অবিবাহিতা তরুণী মেয়ে, এক বয়স্কা বিধবা মেয়ে এবং বৃদ্ধা স্ত্রীর যাবতীয় দুশ্চিন্তা পৃথিবী নামের এই গ্রহটিতে ফেলে রেখে চিরকালের মতো তিনি চোখ বুজেছেন। বিনয়ের মনে পড়ল, তার স্ত্রী এবং মেয়েরা তার ভাইপো বিমলের কাছে উঠেছে। বিমলের ঠিকানা লিখে নিয়েছিল বিনয়। কথা দিয়েছিল একদিন তাদের বাড়ি যাবে। যাওয়া হয়নি। কলকাতায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুককে নিয়ে একের পর এক এত সংকট বেড়াজালের মতো তাকে ঘিরে ধরেছে যে ওদের কথা খেয়াল ছিল না। প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করল বিনয়। ভাবল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বিমলদের বাসায় গিয়ে ওদের খোঁজখবর নেবে।
আশু দত্ত এবং রামরতন গাঙ্গুলির মধ্যে প্রচুর মিল। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। একটা জাতিকে বড় হতে হলে সুশিক্ষিত, আদর্শবাদী মানুষ দরকার। যৌবনের শুরু থেকে মানুষ গড়ার কাজটাই নিষ্ঠাভরে করে গেছেন তারা। কিন্তু স্বাধীনতার পর কী মূল্য পেলেন দুজনে? জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে, শূন্য হাতে আত্মীয় পরিজনের কাছে একটু আশ্রয়ের আশায় সপরিবারে তাঁদের পাড়ি দিতে হয়েছে। মৃত্যু রামরতনের সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়েছে। কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা আশু দত্তকে যেন গিলে ফেলছে।
বিনয় বলল, অত ভাবছেন কেন স্যার? ইন্ডিয়ায় যখন পৌঁছতে পেরেছেন, রোজগারের একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আশু দত্ত বললেন, এই বৃদ্ধ বয়েসে কে আমাকে স্কুলে চাকরি দেবে?
রিফিউজি বোঝাই গোয়ালন্দের স্টিমারে দোতলার ডেকে বসে অবিকল এইরকম প্রশ্নই করেছিলেন রামরতন। বিনয় বলল, স্যার, আপনি পণ্ডিত মানুষ। স্কুলে কাজ না পেলেও ছাত্র পড়িয়ে অনেক টাকা পেতে পারেন।
ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছিলেন আশু দত্ত। তাঁর শিরদাঁড়া টান টান হয়ে যায়। কঠোর গলায় বলেন, তুই কি প্রাইভেট টিউশনের কথা বলছিস?
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছুর আভাস রয়েছে যাতে হকচকিয়ে যায় বিনয়। ভয়ে ভয়ে বলে, হ্যাঁ, মানে পরক্ষণে সেই ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শীতগ্রীষ্ম বারোমাস প্রতিদিন সন্ধের পর পুরানো সাইকেলে চেপে সারা রাজদিয়া টহল দিয়ে বেড়াতেন আশু দত্ত। মৃধা বাড়ি, রক্ষিত বড়ি, সৈয়দ বাড়ি, ঘটক বাড়ি-এমনি নানা জায়গায় হানা দিয়ে দেখতেন তার স্কুলের কোন ছাত্রটি পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছে, কে অ্যারিথমেটিকের প্রবলেমের অঙ্ক কষতে হিমসিম খাচ্ছে, কার মাথায় বাংলা ব্যাকরণের সমাস ঠিকমতো ঢুকছে না, কে ইতিহাসের মুঘল বাদশাদের রাজত্বকালের সাল তারিখের হিসেব রাখতে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। সবার ভুলটুল শুধরে, পড়াগুলো জলবৎ বুঝিয়ে দিয়ে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন প্রায় মধ্যরাত। এর জন্য কারও কাছ থেকে কখনও একটি পয়সাও তিনি নেননি।
আশু দত্ত ধমকে ওঠেন, প্রাইভেট টিউশন করে টাকা নেব! কী বলছিস তুই? এতখানি সাহস তোর হল কী করে? তার ভেতর থেকে রাজদিয়ার সেই প্রবল পরাক্রান্ত মাস্টার মশাইটি লহমার জন্য আগুনের ঝলকের মতো বেরিয়ে আসেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ফের ঝিমিয়ে পড়েন, নির্জীব সুরে বলেন, কে জানে, পেটের জন্যে শেষপর্যন্ত হাত পেতে তাই হয়তো নিতে হবে। গভীর নৈরাশ্যে তার গলা বুজে আসে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
আশু দত্তর কথা শুনতে শুনতে ঝিনুকের চিন্তাটা কখনও চাপা পড়ে যায়, আবার সেটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু সরাসরি ঝিনুক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। যা জানার কৌশলে জানতে হবে।
বিনয় বলল, আসার সময় আমার দাদুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
আশু দত্ত বললেন, রওনা হওয়ার আগের দিন হেমদাদার বাড়ি গিয়েছিলাম। তাকে বললাম আমরা চলে যাচ্ছি। আপনিও যত তাড়াতাড়ি পারেন ইন্ডিয়ায় চলে যান। কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি আসবেন না। অনেক বুঝিয়েও কাজের কাজ কিছু হল না। কোন দিন যে কী বিপদ ঘটে যাবে!
হেমনাথের অনড় মনোভাবের কথা বিনয়ের অজানা নয়। সেজন্য তার পাহাড়-প্রমাণ দুশ্চিন্তা। নিজের থেকে যদি তিনি না বোঝেন কী নিদারুণ বিপদের মধ্যে আছেন, অন্যে কী আর করতে পারে? কিন্তু এই মুহূর্তে ঝিনুকের ভাবনাটাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিনয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বাড়িতে দাদু ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা হল?