কিছুদিন আগে হেমনাথের চিঠিতে বিশদভাবে না হলেও এ-সবের ইঙ্গিত ছিল। নতুন করে উৎকণ্ঠায় মন ভরে যেতে থাকে বিনয়ের।
আশু দত্ত থামেননি, আমার ক্ষতিটা হয়েছে দুদিক থেকে। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম।
উত্তর না দিয়ে পলকহীন রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে বিনয়।
আশু দত্ত জানান, রাজদিয়া হাইস্কুল–যা ছিল যৌবনের শুরু থেকে তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, কলকাতায় ভাল ভাল চাকরির শত প্রলোভন উপেক্ষা করে তাই নিয়েই জীবনের মহার্ঘ বছরগুলি কাটিয়ে দিয়েছেন। উনিশ শ সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্টের পর যখন পূর্ব পাকিস্তানে ভাঙন ধরল তখনও তিনি তার চিরদিনের সেই স্বপ্নটাকে আঁকড়ে রাজদিয়ায় পড়ে রইলেন। দেশ দুটুকরো হয়েছে, দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বিষবাষ্পে সমস্ত পরিবেশ ছেয়ে গেছে, কিন্তু সে-সব দিকে তার লক্ষ ছিল না। রাজদিয়া হাই স্কুল থেকে নতুন নতুন ছাত্র বেরিয়ে, তাদের মেধা দিয়ে সদ্যোজাত পাকিস্তানকে গড়ে তুলবে, এই নিয়েই তিনি বিভোর ছিলেন।
কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হল আচমকা। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। রাজদিয়া হাই স্কুলের গভর্নিং বডিতে হেমনাথ ছাড়াও রাজদিয়া তো বটেই, চারপাশের গ্রামগুলোর বেশ কিছু সুশিক্ষিত, বিশিষ্ট মানুষজনও ছিলেন। মুসলিম লিগ একরকম গায়ের জোরে গভর্নিং বডি ভেঙে দিয়েছে। আমূল বদলে দিয়েছে সমস্ত কিছু। মোতাহার হোসেন যে স্কুলে একটানা ছাব্বিশ বছর ধরে হেড মাস্টার, কংগ্রেস করার অপরাধে রাতারাতি তাকে তাড়ানো হয়েছে। আশু দত্ত এবং আরও কয়েকজন মাস্টার মশাইকে, প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে যাঁরা রাজদিয়া হাই স্কুল গড়ে তুলেছেন তাদের রিটায়ারমেন্টের নোটিশ ধরিয়ে একরকম ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বিদায় করে দেওয়ায় রাজদিয়া এবং চারপাশের বহু মানুষ খুব ক্ষুব্ধ। ছাত্ররা একদিন স্ট্রাইকও করেছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
রাজদিয়ায় হেমনাথ এবং মোতাহার হোসেনের পর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ আশু দত্ত। এত বড় অসম্মানে তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় আঘাত এসেছিল অন্য দিক থেকে। তার ছোট ভাই সুরেশ দত্ত রেলে চাকরি করতেন। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গার্ড। অবিবাহিত। থাকতেন ঢাকায় রেলের কোয়ার্টার্সে। দেশভাগের সময় সরকারি আধা-সরকারি কর্মচারীদের অপশন দেওয়া হয়েছিল, ইচ্ছা হলে যে কেউ ইন্ডিয়ায় চলে যেতে পারে। সুরেশ দত্ত পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন। ছুটিছাটায় বাড়ি আসতেন। খুব বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইদানীং হয়নি ঢাকায়। তবে উত্তেজনা রয়েছে। মাঝে মাঝেই স্ট্যাবিংয়ের ঘটনা ঘটছে। একদিন রাতে ডিউটি সেরে ফেরার পথে সুত্রাপুরের কাছে তাকে ছুরি মারা হয়। রক্তাপ্লুত বেহুঁশ অবস্থায় সুরেশকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার জ্ঞান আর ফেরেনি। দুদিন পর তিনি মারা যান।
এই মৃত্যুটা আশু দত্তদের তুমুল ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। ঢাকা থেকে শোচনীয় খবরটা আসার সঙ্গে সঙ্গে আশু দত্তর মা মূৰ্ছিত হয়ে পড়েন। হুঁশ ফেরার পর শোককাতর বৃদ্ধা আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। সারাক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকতেন। আর মাঝে মাঝেই উন্মাদের মতো বুকে চাপড় মারতে মারতে আকুল হয়ে কাঁদতেন। তার কান্নার আওয়াজ অনেকটা তীরবেধা পশুর আর্তনাদের মতো। এক মুহূর্তও তিনি পাকিস্তানে থাকতে চাইছিলেন না। অবিকল ঝিনুকের মতো।
নিরুপায় আশু দত্ত শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানে আর থাকবেন না। গোপনে পূর্বপুরুষের বাড়িঘর জমিজমা বিক্রি করার চেষ্টা যে করেননি তা নয়। কেননা জানাজানি হলে রাজাকাররা প্রচণ্ড হামলা করবে। হিন্দুর সম্পত্তি বেচা প্রায় অসম্ভব। খদ্দের তিনি পেয়েও ছিলেন। কিন্তু তারা ভয়ে আশু দত্তর সঙ্গে রেজিস্ট্রি অফিস পর্যন্ত যেতে পারেনি। অগত্যা বাড়িতে তালা লাগিয়ে সম্পত্তির দলিলপত্র সঙ্গে নিয়ে মায়ের হাত ধরে নৌকোয় উঠেছিলেন। তারপাশা স্টিমারঘাটে আসা, গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে বর্ডারে পৌঁছনো বিনুর যা যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রায় তেমনটাই ঘটেছে আশু দত্তর বেলায়। সেই আতঙ্ক, সেই উৎকণ্ঠা, সেই মৃত্যুভয়। ভেবেছিলেন, পাকিস্তানে উত্তেজনা কমলে, পরিবেশ খানিকটা স্বাভাবিক হলে, দেশে ফিরে বাড়িঘরের ব্যবস্থা করে আসবেন। কিন্তু বর্ডারে পৌঁছবার পর আরেকটা মারাত্মক আঘাতে শেষ আশাটুকুও চুরমার হয়ে গেল। পাকিস্তানি অফিসাররা তাঁর যাবতীয় দলিল-টলিল ছিনিয়ে নেয়। দুঃস্বপ্নের সীমান্ত পেরিয়ে তিনি যখন কলকাতায় এলেন, একেবারে নিঃস্ব। কপর্দকহীন। সেই সঙ্গে ভাইয়ের ভয়াবহ মৃত্যুতে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।
একনাগাড়ে বলে যাবার পর থামলেন আশু দত্ত। জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগলেন।
ঘোড়ার গাড়ির ভেতর স্তব্ধতা নেমে আসে। কেমন যেন দমবন্ধ করা পরিবেশ, ভীষণ অস্বস্তিকর। বাইরে থেকে অশ্বক্ষুরের ধ্বনি আর পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া যানবাহন এবং মানুষজনের কলরোল ভেসে আসছে যথারীতি।
ঝিনুকের চিন্তাটা ফের মাথায় ফিরে আসে বিনয়ের। কিন্তু কীভাবে তার কথা জিজ্ঞেস করবে, ঠিক করে উঠতে পারছে না।
অনেকক্ষণ আচ্ছন্নের মতো বসে থাকার পর আশু দত্ত আবার শুরু করেন, এক জামাকাপড়ে মাকে নিয়ে দেশ থেকে চলে এলাম। মাসতুতো ভাইয়ের ক্ষমতা আর কতটুকু? শুনেছি সে প্রাইভেট ফার্মের কেরানি। স্বামী, স্ত্রী, তিন চারটে ছেলেমেয়ে। তার ওপর মা আর আমি এসে ওদের ঘাড়ে চাপলাম। কী করে যে চালাবে? কী হবে আমাদের? তাঁকে খুবই অসহায় দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতের চিন্তায় ব্যাকুল।