আশু দত্ত বললেন, চারদিকে এত শোরগোল, তোর ডাক শুনতে পাইনি। বিনয়কে বললেন, ট্রেন থেকে নেমে মহা বিপদে পড়ে গেছি।
বিনয় জানতে চায়, কী বিপদ স্যার?
আমার এক মাসতুতো ভাইকে চিঠি লিখেছিলাম। শিয়ালদায় এসে আমাদের যেন নিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। তাকে কোথাও পেলাম না।
আপনি শোনেননি, আজকাল পাকিস্তানের চিঠি ঠিকমতো এপারে আসে না? হয়তো আপনার ভাই চিঠি পাননি।
আশু দত্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। ভীষণ উদ্বিগ্ন। উদ্ভ্রান্তের মতো বলেন, এখন উপায়?
বিনয় বলে, কীসের?
আশু দত্ত জানালেন, উনিশ শউনচল্লিশের জুলাইয়ে, মহাযুদ্ধ শুরু হবার মুখে কলকাতায় শেষ এসেছিলেন। তারপর এই। মাঝখানে প্রায় একটা যুগ কেটে গেছে। এই শহর তার প্রায় অচেনা। নৌকোয় স্টিমারে এবং ট্রেনের দম বন্ধ করা ভিড়ে তিনটে দিন কেটেছে। প্রচণ্ড ধকলে বৃদ্ধা মা এবং তাঁর শরীরে সারবস্তু কিছু আর অবশিষ্ট নেই। হাত-পা ভেঙে হুড়মুড় করে যে-কোনও মুহূর্তে পড়ে যাবেন। কীভাবে যে নিজেদের খাড়া রেখেছেন, তারাই জানেন। এই অবস্থায় কেমন করে মাসতুতো ভাইয়ের বাসায় পৌঁছবেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
বিনয় জিজ্ঞেস করে, ঠিকানা জানেন তো?
তা জানি। ভাইয়ের নাম সন্তোষ–সন্তোষ নাগ। ঠিকানা সাতাশের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট। কালীঘাট।
চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।
দুর্ভাবনার আপাতত কিছুটা অবসান। মুখচোখ দেখে মনে হল, আশু দত্ত খানিক স্বস্তি বোধ। করছেন। বললেন, তোর সঙ্গে দেখা না হলে কী যে করতাম! কিন্তু
কী?
এখানে তোর অন্য কোনও কাজ নেই তো? আমাদের নিয়ে গেলে অসুবিধে হবে না?
না স্যার। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরব।
কীভাবে কালীঘাট যাব?
বিনয় লক্ষ করল, এই মুহূর্তে একটি মাত্র চিন্তাই আশু দত্তর মাথায় ভর করে আছে। কালীঘাটে মাসতুতো ভাইয়ের বাড়ি নিরাপদে পৌঁছতে হবে। এছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। বিনয়ের সঙ্গে কত দিন বাদে দেখা। কেন সে শিয়ালদায় এসেছিল, কলকাতার কোথায় থাকে সে, দেশ। থেকে এখানে এসে কেমন আছে, এ-সব সম্বন্ধে তাঁর এতটুকু আগ্রহ নেই।
বিনয় জানালো, কালীঘাট অনেক দূরের পথ। ট্রাম বাস পালটে যাওয়া যায়। কিন্তু আশু দত্তরা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যেভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আছেন, তাতে ভিড়ে-ঠাসা যানবাহনে টানাচড়া করে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। সে বলল, এখান থেকে একটা ঘোড়ার গাড়ি নেব।
আশু দত্তর হঠাৎ কী খেয়াল হল। উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, আমার কাছে হাজারখানেক পাকিস্তানি টাকা আছে। ইন্ডিয়ায় কি সেই টাকা চলবে?
বিনয় জানায়, এই শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরেই চড়া হারে বাট্টা দিলে পাকিস্তানি টাকার বদলে ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়।
আশু দত্ত জামার ভেতরের পকেট থেকে টাকা বার করে বিনয়কে দিতে দিতে বললেন, বদলানোর ব্যবস্থা কর।
একসময় মেন স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে দালালদের কাছ থেকে টাকা বদলাবদলি করে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল বিনয়। আশু দত্ত এবং তার মাকে গাড়িতে তুলে নিজেও উঠে বসল। যুগল সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। সে আশু দত্তদের মালপত্র গাড়িতে তুলে দিল।– এতক্ষণে যেন যুগলের ওপর ভালভাবে নজর পড়ল আশু দত্তর। খানিক আগে বিনয়ের সঙ্গে সেও যে তাঁকে প্রণাম করেছে, বুঝি বা তা লক্ষ করেননি। উৎকণ্ঠায়, দুর্ভাবনায় তখন তিনি দিশেহারা। বললেন, তুই যুগল না?
যুগল অল্প হাসল, হ মাস্টর মশয়।
গাড়িতে উঠলি না যে?
আশু দত্তর প্রশ্নের জবাবটা দিল বিনয়, ও কলকাতার বাইরে থাকে। আগরপাড়ায়। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে ওকে যেতে হবে।
অনেক দূরে?
না। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে। আগরপাড়ায় নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়।
আশু দত্ত যুগল সম্বন্ধে আর কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।
যুগল বলল, আমার টেরেনের সময় হইয়া আইছে। অহন যাই মাস্টর মশয়। পরে ছুটোবাবুরে লইয়া আপনের লগে দেখা করুম। সে স্টেশনের দিকে ফিরে গেল।
অশ্বক্ষুরের আওয়াজ তুলে বিনয়দের গাড়ি শিয়ালদার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় চলে এল।
এর মধ্যে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। রাস্তায় কর্পোরেশনের বাতি জ্বলে উঠেছে। গাঢ় কুয়াশা ক্রমশ সেগুলোর টুটি টিপে ধরতে শুরু করেছে। দুধারের সারি সারি দোকান এবং বাড়িগুলোতেও প্রচুর আলো। কিন্তু শীতের সন্ধ্যায় গাঢ় কুয়াশার কারণে সেগুলোও কেমন যেন নিস্তেজ। মলিন। চারদিকে প্রচুর লোকজন। স্রোতের মতো ছুটে চলেছে ট্রাম বাস মোটর ট্যাক্সি, ইত্যাদি।
.
০৪.
ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে মুখোমুখি লম্বাটে সিট। একদিকের সিটে বসেছে বিনয়। তার সামনের সিটটায় আশু দত্ত এবং তার মা। গাড়ির দোলানিতে বৃদ্ধার ঘুম এসে গিয়েছিল। তিনি ঢুলছিলেন। আশু দত্ত জানালার বাইরে ধাবমান গাড়িঘোড়া মানুষজন এবং দোকানপাটের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই তখন দেশ ছেড়ে আসার কথা জিজ্ঞেস করছিলি না?
খানিক আগে শিয়ালদা স্টেশনে মাসতুতো ভাইকে দেখতে না পেয়ে আশু দত্ত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। বিনয় বুঝতে পারে, সেই অস্থির অস্থির ভাবটা এখন অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছেন। আস্তে মাথা নেড়ে সে বলে, হ্যাঁ।
আশু দত্ত বললেন, দিনকে দিন দেশের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে উঠছে। হিন্দুরা কতদিন সেখানে থাকতে পারবে, জানি না। একটু চুপ করে থেকে ফের শুরু করলেন, ইন্ডিয়া থেকে কিছু বিহারী মুসলমান রাজদিয়ায় গিয়ে উঠেছে। তারা স্থানীয় লোকজনদের খুব তাতাচ্ছে। তাছাড়া রাজাকারদের উৎপাতও বেড়ে গেছে।