আইতে আছে, আইতে আছে—
পাকিস্থানের টেরেন আইতে আছে।
ঝিনুককে না পেয়ে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল বিনয়। নইলে ট্রেন আসার শব্দটা নিশ্চয়ই শুনতে পেত। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, অনেক দূরে ডিসটান্ট সিগনালের ওধারে একটা ইঞ্জিন প্রকাণ্ড সরীসৃপের মতো ট্রেনের কামরাগুলো টানতে টানতে দুরন্ত গতিতে এদিকে ধেয়ে আসছে। সেটার কপাল থেকে হেডলাইটের তীব্র আলোর ছটা চারপাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে।
যুগল বলল, পাকিস্থানের টেরেন। ইট্টু খাড়ন ছুটোবাবু। দেহি যদিন আমাগো উইদিকের চিনাজানা (পরিচিত) কেও আইয়া থাকে। শরণার্থীদের ট্রেন দেখে রাজদিয়া অঞ্চলের মানুষজন সম্পর্কে পুরানো উদ্দীপনা আবার ফিরে এসেছে তার।
যুগল থেমে গিয়েছিল। তাকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। অগত্যা বিনয়ও দাঁড়িয়ে পড়ল। চকিতে তার মনে হল, এমনও তো হতে পারে, ঝিনুক সত্যিই রাজদিয়ায় ফিরে গেছে। আজকের এই ট্রেনে ওখানকার কেউ যদি এসে থাকে, তার কাছে হয়তো ঝিনুকের খবর পাওয়া যাবে। সেই যে নিত্য দাস হেমনাথের চিঠি নিয়ে এসেছিল এবং পরে সেই চিঠির উত্তর নিয়ে চলে গিয়েছিল, তারপর আর লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। রিফিউজিদের জন্য নির্দিষ্ট আজকের স্পেশাল ট্রেনটায় পরিচিত কারও দেখা মিললে শুধু ঝিনুকই নয়, হেমনাথদের সম্পর্কেও জানা যাবে।
চারদিক ঝাঁপিয়ে, সিটি দিতে দিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। লম্বা দৌড় শেষ। কয়লার ইঞ্জিন ফোঁস ফোঁস করে এখন হাঁপাচ্ছে।
মাসখানেকও কাটেনি, এমনই একটা ট্রেনে গোয়ালন্দ থেকে ঝিনুককে নিয়ে শিয়ালদায় এসেছিল বিনয়। সেদিনের মতো আজও প্রতিটি কামরায় গাদাগাদি ভিড়। ছাদের ওপরও অজস্র মানুষ, নানারকম লটবহর। বাক্স-পেটরা, পোঁটলা-পুটলি, হাঁড়িকুড়ি, ডালাকুলো, এমনই নানা জিনিস। যে যেটুকু পেরেছে, নিয়ে এসেছে।
পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর ইন্ডিয়ায় এসেও সবাই দিশেহারা। হয়তো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বিহুলের মতো তারা তাকিয়ে তাকিয়ে আলোকোজ্জ্বল স্টেশনের মানুষজন দেখছে। অনেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী সব বলছে। তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা। প্রতিটি কামরা থেকে বাচ্চাদের কান্না ভেসে আসছে।
প্রতিদিন রিফিউজি স্পেশাল এলে যা হয়, আজও তার হেরফের নেই। মাইকে অবিরাম ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তান থেকে যারা এসেছেন, হুড়োহুড়ি করবেন না। সবাই সুশৃঙ্খলভাবে নেমে আসুন। সবার জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করা আছে, ইত্যাদি। সরকারি ত্রাণবিভাগের কর্মীরা প্রতিটি কামরার সামনে গিয়ে উদ্বাস্তুদের ধীরে ধীরে নামিয়ে আনছে।
শিয়ালদায় এলে যা করে থাকে, আজও তাই করতে লাগল যুগল। কামরায় কামরায় হানা দিয়ে গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে একটানা হেঁকে যাচ্ছে, রাইজদা দেলভাগ রসুইনা ডাকাইতা পাড়া মাইনকার চর গিরিগুঞ্জ সুজনগুঞ্জ থিকা কেউ আইয়া থাকলে হুমৈর দ্যান,
বিনয় যুগলের সঙ্গে যায়নি। প্ল্যাটফর্মের কোনায় দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছিল।
অনেকক্ষণ পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল যুগল। দশ কম্পার্টমেন্টের ট্রেনটা বিশাল লম্বা; পুরো প্ল্যাটফর্ম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাসা ভিড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনের শেষ মাথায় গিয়ে আবার এতটা ফিরে আসা মুখের কথা নয়।
যুগল বলল, আমাগো রাইজদার দিকের কেউ আইজকার গাড়িতে আহে নাই। লন (চলুন) যাই–
দুজনে গেটের দিকে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। কয়েক পা গেছে, পেছন থেকে কেউ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকল, বিনু–এই বিনু
গলার স্বরটা খুবই পরিচিত। চমকে ঘুরে দাঁড়াল বিনয়। আর তখনই রাজদিয়া হাই স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার আশু দত্তকে দেখতে পেল। এক হাতে থুথুড়ে একজন বৃদ্ধাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন। আরেক হাতে চামড়ার মাঝারি সুটকেস, বগলে শতরঞ্চি-জড়ানো বিছানা দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার উষ্কখুষ্ক চুলে তেল জল বা চিরুনি পড়ে নি বহুদিন। গালে খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে। দলামোচড়া ধুতি আর টুইলের ফুল শার্ট। পায়ে লাল ক্যাম্বিসের পুরানো ফিতেওলা জুতোর ওপর ধুলোর প্রলেপ। মাথায়, জামাকাপড়ে কয়লার অজস্র কুচি। বোঝাই যায়, এই ট্রেনেই ওঁরা এসেছেন।
বৃদ্ধাটিকে ভালই চেনে বিনয়। আশু দত্তর মা। কতদিন ওঁদের বাড়ি গিয়ে তার হাতের ক্ষীরের নাড়, চিতই পিঠে, চিড়ের মোয়া কি পাটিসাপটা খেয়ে এসেছে।
কয়েক পলক হতবাক তাকিয়ে থাকে বিনয়। রাজদিয়ার এই শ্রদ্ধেয় মাস্টার মশায়টি দেশ ছেড়ে কোনওদিন ইন্ডিয়ায় চলে আসবেন, ভাবা যায়নি। তার ধারণা ছিল, জন্মভূমিতেই তিনি আমরণ থেকে যাবেন।
পাশ থেকে যুগল ব্যগ্র সুরে বলে ওঠে, ছুটোবাবু, আমাগো রাইজদার মাস্টর মশয়– বলেই আশু দত্তর দিকে দৌড়ে গেল।
বিনয়ও লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে গিয়ে আশু দত্ত এবং তার মাকে প্রণাম করে। দেখাদেখি যুগলও দুজনের পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকায়।
প্রশ্নটা অনাবশ্যক। তবু বিনয় জিজ্ঞেস করে, স্যার চলে এলেন? দেশে আর থাকা গেল না বুঝি?
মুখে কিছু বললেন না আশু দত্ত। আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শুধু।
আশু দত্তর হাত থেকে সুটকেস বিছানা টেনে নিয়ে যুগল বলে, টেরেনের এই মাথা থিকা উই মাথায় সমানে ডাইকা গ্যাছি, রাইজদা থিকা কেউ আইছেন? চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া গলার নলি ফাইড়া গ্যাছে। হুমৈর দ্যান নাই ক্যান?