এর মধ্যেই মিহি কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি হিমকণা।
ট্রামরাস্তা দিয়ে পাঁচমেশালি আওয়াজ করে স্রোতের মতো ঊধ্বশ্বাসে ছুটছে অজস্র যানবাহন। ট্রাম বাস রিকশা ট্যাক্সি ঘোড়ার গাড়ি, এমন কত কী। আর রয়েছে মানুষের ভিড়। কেউ থেমে নেই। সবাই দৌড়চ্ছে। কলকাতা সদাব্যস্ত, সতত ধাবমান। লহমার জন্যও কারও দাঁড়িয়ে থাকার জো নেই। সকাল থেকে বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত কলকাতার যে-কোনও বড় রাস্তায় এমনটাই চোখে পড়ে।
ট্রাম লাইন পেরিয়ে এধারে এসে শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে ঢুকে পড়ল বিনয়। চতুর্দিকে সেই পরিচিত দৃশ্য। সীমান্তের ওপার থেকে আসা শরণার্থীতে সমস্ত এলাকা থিক থিক করছে। তাদের রিফিউজি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি বা করা যায়নি। সর্বত্র হই হই, চিৎকার, খিস্তিখেউড়, কুৎসিত কলহ।
ভিড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে করে তার নিজস্ব কায়দায় একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছিল যুগল, ঝিনুক বইন আছ? থাকলে হুমৈর (সাড়া) দাও। ছুটোবাবুও আমার লগে আছে। যেইখানেই থাক হুমৈর দাও, হুমৈর দাও তার কণ্ঠস্বর শীতঋতুর বায়ুতরঙ্গে ভাসতে ভাসতে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
বিনয়ও চারপাশে ব্যগ্র চোখে উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ঝিনুক বইন, ঝিনুক বইন করে চিৎকার করার ফাঁকে ফাঁকে পূর্ব পাকিস্তানের যে উদ্বাস্তুরা পঁচিশ তিরিশ বর্গফুট জায়গা দখল করে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী সংসার পেতে বসেছে তাদের কাছেও খোঁজখবর নিচ্ছে যুগল, বয্যের (যুবতী) এক মাইয়া, অবিয়াত (অবিবাহিত), সোন্দরী, একইশ বাইশ বচ্ছর বস (বয়স), নাম হইল ঝিনুক। বড় দুখী, পাগল পাগল অবস্থা। দ্যাশ আছিল ঢাকা জিলার রাইজদা। তেনারে আপনেরা কেও দেখছেন?
দেশের ভিটে থেকে উৎখাত এইসব মানুষ, যে-যার নিজের নিজের হাজারো সমস্যায় এবং ভবিষ্যতের চিন্তায় আচ্ছন্ন। তারা জানায়, এমন কারওকে দেখেনি। অন্যদিকে নজর দেবার সময় কোথায় তাদের?
গোটা চত্বর ঘুরতে ঘুরতে সন্ধে নেমে গেল। কুয়াশা দ্রুত গাঢ় হচ্ছে। সেই সঙ্গে গাড়ির ধোঁয়া আর ধুলো মাখামাখি হয়ে সব কেমন যেন আবছা আবছা।
একসময় দুজনে শিয়ালদা সাউথ সেকশনের স্টেশনের ভেতর চলে এল। এখানেও শয়ে শয়ে উদ্বাস্তু। বুড়োবুড়ি, যুবকযুবতী, মাঝবয়সী পুরুষ এবং মেয়েমানুষ, বাচ্চাকাচ্চা। আশাহীন, ভবিষ্যৎহীন নরনারীর দল। যেদিকেই তাকানো যাক, সারি সারি ভাঙাচোরা, সন্ত্রস্ত মুখ। আঁতিপাঁতি করে খুঁজে এখানেও ঝিনুককে পাওয়া গেল না।
এবার বিনয়রা এল শিয়ালদা মেন স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মের এক মাথা থেকে আর এক মাথা অবধি যে ছিন্নমূল মানুষেরা সীমান্তের এপারে এসে ইটের সীমানা-ঘেরা ছোট ছোট খোপের ভেতর পড়ে আছে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে ঝিনুকের চেহারার বর্ণনা দিয়ে খোঁজ করল। না, ঝিনুকের সন্ধান এখানেও কেউ দিতে পারল না।
যেখানে অগুনতি মানুষের ঠাসাঠাসি ভিড়, সারাক্ষণ যেখানে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা আর তাণ্ডব চলছে, সেখানে যুগলের বিবরণের সঙ্গে মেলে এমন একটি তরুণী যদি এসেও থাকে, কেউ তাকে লক্ষ করেনি।
চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা চিরে গিয়েছিল যুগলের। সে বলল, কুনোহানেই তো ঝিনুক বইনেরে পাইলাম না। কই যে গেল! অহন কী করন যায় ছুটোবাবু?
বিনয় উত্তর দিল না। শিয়ালদা এসেই ঝিনুককে পাওয়া যাবে, তাও এতদিন বাদে, এমনটা ভাবতে পারেনি সে। তবু যুগলের কথায় তার মনের কোনও গোপন তলদেশে একটু দুরাশার সৃষ্টি হয়েছিল– যদি নিরুদ্দেশ ঝিনুকের সন্ধান মেলে। তাই এখানে ছুটে এসেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে অনুভব করল, বুকের ভেতর ধস নেমেছে। ভেঙেচুরে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। মনে হল জীবন থেকে চিরকালের মতো যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, বৃথাই তার খোঁজে ছোটাছুটি।
শ্রান্ত, হতাশ যুগল এবার বলে, আর এইহানে খাড়ইয়া থাইকা কী হইব? লন (চলুন) যাই গা। আপনেরে ধম্মতলার বাসে উঠাইয়া দিয়া আইসা আগরপাড়ার টেরেন ধরুম। আপনে ধম্মতলা থিকা বাড়িত যাইয়েন গা।
যে যুগল শিয়ালদা এলেই রাজদিয়া ও তার চারপাশের গ্রামগঞ্জ আর ভাটি অঞ্চলের মানুষজনের খোঁজ করে, আজ আর সে-সম্বন্ধে তার কোনও উৎসাহ নেই। দেশের মানুষ সম্পর্কে সব আগ্রহই যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। আসলে ঝিনুকের জন্য দুঃখে, বিষাদে মন ভরে আছে। কিছুই ভাল লাগছিল না তার।
বিনয় বলল, হ্যাঁ, চল– তার কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য মাখানো। এলোমেলো পায়ে যুগলের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে।
প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্ত থেকে গেটের দিকে যখন ওরা বেশ খানিকটা চলে এসেছে সেই সময় গোটা স্টেশন জুড়ে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দিল। প্ল্যাটফর্মের একধারে এখানকার পুরানো শরণার্থীদের দেখাশোনা এবং প্রতিদিন নতুন নতুন যারা আসছে তাদের আশ্রয় আর খাদ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করার জন্য সরকারি রিফিউজি অ্যান্ড রিলিফ ডিপার্টমেন্টের যে ক্যাম্প বসানো হয়েছে সেখান থেকে অফিসার এবং কর্মীরা ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এসে রেললাইনের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ শিয়ালদা স্টেশনে তীব্র শোরগোল। এখন সেটা হাজারগুণ বেড়ে গেছে। পুরানো উদ্বাস্তুরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে কী বলতে লাগল, প্রথমটা বোঝা গেল না। পরে অবশ্য সব স্পষ্ট হল।