- বইয়ের নামঃ শতধারায় বয়ে যায়
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ করুণা প্রকাশনী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল
শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
উৎসর্গঃ সমরেশ মজুমদার অনুজপ্রতিমেষু
প্রসঙ্গত
‘কেয়াপাতার নৌকো’র অখন্ড সংস্করণের ভূমিকায় জানিয়েছিলাম, দেশভাগভিত্তিক এই উপন্যাসের পর আরও কয়েকটি পর্ব ভিন্ন ভিন্ন নামে লিখব। সেই অনুযায়ী ‘কেয়াপাতার নৌকো’-র পরবর্তী পর্ব শতধারায় বয়ে যায় প্রকাশিত হল। আমার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। হাতে সময় বড় কম। তাই এর পরের অংশগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ করতে চাই।
‘শতধারায় বয়ে যায়’ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল বর্তমান পত্রিকার রবিবাসর বিভাগে, দীর্ঘ দু’বছর ধরে। এই বিভাগের সম্পাদক এবং তার সহকারী কাকলি চক্রবর্তী ও সাহানা নাগচৌধুরির অবিরল তাগাদা ছাড়া এটি লেখা আদৌ সম্ভব হতো না। প্রসঙ্গত অনুজপ্রতিম কথাসাহিত্যিক শচীন দাসের কথা না বললেই নয়। সেও এটি লেখার জন্য সমানে আমাকে উসকে গেছে। এদের সঙ্গে আমার যা সম্পর্ক তাতে সামান্য ধন্যবাদ জানানো যথেষ্ট নয়। তিন স্নেহভাজনকে শুধু আন্তরিক শুভকামনাই জানাতে পারি। ‘শতধারায় বয়ে যায়’-এর জন্য পুরনো পত্রপত্রিকার অসংখ্য প্রতিবেদন তো বটেই, বহু বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং সাংবাদিকের গবেষণাগ্রন্থ থেকেও প্রচুর তথ্য পেয়েছি। এঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
দেশভাগের কারণে বাঙালির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে যে মহাতমসা নেমে এসেছিল, এমনটা আর কখনও দেখা যায়নি। এই বিপর্যয়ের জের কাটিয়ে উঠতে কত যুগ লাগবে, কে জানে।
বঙ্গ-বিভাজন শতসহস্র জনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু মানুষ নিদারুণ প্রতিকূলতার মধ্যেও সহজে পরাভব মানে না। ভগ্ন্যুপের ভেতর থেকে সর্বস্ব-হারানো উদ্বাস্তুদের অনেকে মাথা তুলে আবার নিজেদের নির্মাণ করে চলেছে। বিনাশের পাশাপাশি সৃজন।
অনতিদূর অতীতের সেই চরম বিপর্যয়ের সময় থেকে বর্তমান কাল অবধি বাঙালির ধ্বস্ত জীবনকে আমার এই পর্যায়ের উপন্যাসগুলিতে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছে রয়েছে। কিন্তু কতটা সম্ভব হবে জানি না। তবে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাব।
আমি গুরুতর অসুস্থ। তাই প্রফ সংশোধনে কিছু ভুলচুক থেকে যেতে পারে। পরবর্তী সংস্করণে তা ঠিক করে দেব।
—গ্রন্থকার
০১.
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, বিনয়ের খেয়াল নেই। বিহ্বলতা যখন কাটল, মনে হল, শত আলোকবর্ষ পার হয়ে গেছে। রাস্তায় একই রকম ব্যস্ততা, জনস্রোত। কর্পোরেশনের ঘোলাটে-আলোগুলো ঘিরে কুয়াশার ঘোট ঘোট বলয়। ট্রাম বাস ঘোড়ার গাড়ি, এমন অজস্র যানবাহন রকমারি আওয়াজ তুলে আগের মতোই ছুটে চলেছে। চিরদুঃখী এক তরুণী উদ্ভ্রান্তের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেছে, জানা নেই। কিন্তু মহানগরের আহ্নিক গতিতে লহমার জন্যও তাল কাটেনি। সবই আগের মতো চলমান। ধ্বনিময়। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু নেই।
বিনু আর সেই বিনু নেই। দেশভাগের পর নানা ঘা খেয়ে খেয়ে অজস্র অভিজ্ঞতায় এখন সে এক পরিপূর্ণ যুবক। [কেয়াপাতার নৌকো’র বিনু জীবনের এই পর্ব থেকে বিনয়।
হিম ঝরে চলেছে বিরতিহীন। শীতল উত্তুরে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। উত্তর থেকে দক্ষিণে। গায়ে কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু শরীর কেমন যেন অনুভূতিশূন্য। চোখের সামনে মানুষজন, গাড়িঘোড়া সব ছেঁড়া ছেঁড়া, ঝাপসা ছবির মতো। অসংলগ্ন। একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও যোগ নেই।
অসাড় ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাবার পর বিনয়ের মনে হয়, মাথায় অবিরল ধারালো শেল বিধছে। বুকের ভেতর কী যে অসহ্য যন্ত্রণা! কেউ যেন অতল অন্ধকার খাদে তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। শ্বাস আটকে আটকে আসছে তার।
লক্ষ লক্ষ মানুষের এই আধো-চেনা শহর দিগ্বিদিকে ছড়ানো, এখানে ঝিনুককে কোথায় খুঁজবে বিনয়? কোথায় গেলে তাকে ফিরে পাওয়া যাবে, জানা নেই।
ঝিনুক যে কত মায়ায়, কত অজস্র পাকে, তাকে আমূল জড়িয়ে আছে, সেই কিশোর বয়স থেকেই বিনয় অনুভব করে এসেছে। নইলে এত ঝুঁকি নিয়ে সে কি ওকে বুকের ভেতর আগলে আগলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে আসতে পারত? প্রতি মুহূর্তে সেখানে ছিল ঘাতক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। জলেস্থলে সর্বক্ষণ সেখানে মৃত্যুভয়। আকাশ বাতাস বিষ-বাষ্পে ভরা। কিন্তু ঝিনুকের জন্য কিছুই গ্রাহ্য করেনি বিনয়।
এখন, হেমন্তের এই কুহেলিমাখা রাত্তিরে, কলকাতার সদাব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝিনুক যে তার জীবনের শত দিগন্ত জুড়ে রয়েছে, নতুন করে আবার তা টের পেল সে। একটা হুহু কান্না শরীরের রক্তমাংস ভেদ করে বেরিয়ে আসছে।
কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া যাবে না। কিছু একটা করতেই হবে বিনয়কে। কী করা যায়?
এতক্ষণ ঝিনুকের চিন্তাটা এমন ব্যাকুল করে রেখেছিল যে অন্য কিছুই ভাবতে পারছিল না বিনয়। হঠাৎ অবনীমোহনের মুখ, চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা নিশ্চয়ই কোনও একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। পরক্ষণে মাথায় সংশয়ের মেঘ জমে। অবনীমোহন কি ঝিনুককে খুঁজে বার করার জন্য আদৌ কিছু করবেন? একটা ধর্ষিত মেয়ে আচমকা এসে তাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে, ঘটিয়েছে তার শাস্তির ব্যাঘাত। হঠাৎ সে চলে যাওয়ায় তার তত খুশি হওয়ারই কথা। অনন্ত স্বস্তি। অবাঞ্ছিত আপদ বিদায় হলে যেমনটা হয় আর কি।