তা ছাড়া আরও দু-একটা ব্যাপার চোখে পড়েছিল অবনীনাথের। অনীতার বাবা তাঁদের দেখে যতটা খুশি বা উচ্ছ্বসিত, তার মা কিন্তু ঠিক ততটা নন। এমনিতে তাঁর ভদ্রতা বা সৌজন্যের মধ্যে কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু কোথায় যেন সূক্ষ্ম পর্দা টানা ছিল। টের পাওয়া যাচ্ছিল, তিনি ঠিক তাঁর স্বামীর মতো সবাইকে কাছে টানতে পারেন না। কেমন যেন গম্ভীর আর দূরবর্তী।
এ তো গেল অনীতার মায়ের কথা। অনীতাকে তাদের বাড়িতে দেখেও কম অবাক হননি অবনীনাথ। যে বাইরে এত হাসিখুশি এবং আমুদে বাড়িতে নিজেকে সে অনেকখানি গুটিয়ে রেখেছিল। আর সেই ঘাড়ে গর্দানে ঠাসা যুবকটি যার নাম নবকুমার যে সুযোগ পেলেই জোঁকের মতো অনীতার গায়ে আটকে থাকতে চাইছিল; নইলে দূর থেকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছিল। তাকানোর মধ্যেও যে এমন বিশ্রী ধরনের নোংরা লোভ আর হ্যাংলামি থাকতে পারে, এই যুবকটিকে না দেখলে বোঝা যেত না।
অনীতার বাবা অনিমেষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমার নিজেরই আপনাদের বলে আসা উচিত ছিল কিন্তু বাড়ির কাজে আটকে ছিলাম, তাই অনুকে পাঠিয়েছিলাম।
মামা বলেছিলেন, তাতে আমাদের এতটুকু অসম্মান হয়নি। অনু বলেছিল দুর্দান্ত খাওয়া-দাওয়ার নাকি ব্যবস্থা করেছেন। মুরগির মাংসের গন্ধ পেলে আমার নেমন্তন্নর দরকার হয় না। হাওয়া শুঁকে শুঁকে ঠিক হাজির হয়ে যাই।
মামি বলেছিলেন, দিনরাত খাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবনা নেই। পেটটাই সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবাই হেসে উঠেছিল।
মামা আবার বলেছিলেন, কিন্তু অনিমেষবাবু, কী অকেশনে আজকের খাওয়া-দাওয়া সেটা কিন্তু এখনও জানি না। অনুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ও মিষ্টিরিয়াসলি হেসে অ্যাভয়েড করে গেল।
অনিমেষ বললেন, মেয়েটা বি.এ-তে ভালো রেজাল্ট করেছে। সেই জন্য সবাইকে দুটি ডাল-ভাত খাওয়াবার ইচ্ছা হল।
একসেলেন্ট। আশীর্বাদ করি এম.এ-তে ভালো রেজাল্ট করুক অনু, রিসার্চ করে ডক্টরেট হোক। যতবার ভালো রেজাল্ট তত বার গ্র্যান্ড ফিস্ট।
প্রায় সবাই একসঙ্গে কোরাসে বলে উঠেছিল, এ প্রস্তাব আমরা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি।
এরপর খানিকক্ষণ নানা ধরনের গল্প চলল। হিটলার, চেম্বারলেন, রাশিয়া, ইউরোপে যুদ্ধের অ্যাটমসফিয়র, কলকাতার বাজারদর–এমনি নানা টপিক নিয়ে আলোচনার ফাঁকে অনীতার বন্ধু অরুন্ধতী বলেছিল, এসব গল্প ভালো লাগছে না মেসোমশাই। খাওয়ার আগে অনীতার গান শুনতে চাই।
ঘরের সবাই সমস্বরে সায় দিয়েছিল, গুড় প্রপোজাল। এতক্ষণ শুধু শুধু আজে-বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করা হল। অনু স্টার্ট করে দাও। অনেক দিন তোমার গান-টান শোনা হয়নি।
অনীতা প্রথমে গাইতে চায়নি। কিন্তু ওর আরেক বন্ধু মালতী ততক্ষণে একটা হারমোনিয়াম এনে সেটার সামনে ওকে জোরজার করে বসিয়ে দিয়েছিল।
অগত্যা গাইতেই হয়েছে অনীতাকে। সবই রবিবাবুর গান; এ ছাড়া দুটি করে অতুলপ্রসাদী আর ডি.এল. রায়ের গান।
সেই নাইন্টিন থার্টি নাইনে অর্থাৎ যুদ্ধের আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত এত পপুলার হয়নি। রবিবাবুর গানের এত রেকর্ড তখন বেরোয়নি। এখনকার মতো রাস্তায় রাস্তায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের স্কুল দেখা যেত না। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা গীতবিতান আর হারমোনিয়াম নিয়ে বসত না। সায়গল, মালতী ঘোষাল, কণক দাস, পঙ্কজ মল্লিক বা আরও কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। তাঁদের গান তো আর সামনে বসে শোনা যেত না।
অবনীনাথদের রামপুরহাটের বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতন খুব দূর না। একবার রবীন্দ্রনাথকে দেখবার জন্য ওখানে গিয়ে সেখানকার ছেলেমেয়েদের বর্ষামঙ্গল না কীসের গান যেন শুনে এসেছিলেন তিনি। তারপর কাছে বসে সেদিন অনীতার মুখে আবার রবিবাবুর গান শুনলেন।
নাম-করা আর্টিস্টদের রেকর্ড বাদ দিলে এমন ভরাট সুরেলা গলা আগে আর কখনও শোনেননি অবনীনাথ। সমস্ত ঘরের আবহাওয়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর আশ্চর্য এক পবিত্রতা এনে দিয়েছিল। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন অবনীনাথ।
কে যেন অনীতাকে বলেছিল, এত সুন্দর গলা তোমার; একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবিবাবুকে গান শুনিয়ে এসো। কবি খুব খুশি হবেন।
অনীতা বলেছিল, যাবার খুব ইচ্ছে। সুযোগ পেলে একবার নিশ্চয়ই যাব।
আরেকজন, খুব সম্ভব অনীতার পিসেমশাই বলে উঠেছিলেন, রেডিয়োতে একটা অডিশান দিয়ে দে অনু; নিশ্চয়ই তুই চান্স পেয়ে যাবি।
অনীতা বলেছিল, দূর, আমি কী এমন গাই যে চান্স পাব।
যেই যুবকটি–যার নাম নবকুমার, ধূর্ত লোভী চোখ নিয়ে সে প্রথম থেকে অনীতার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে এবার বলেছে, রেডিয়োতে তোমাকে গাইতেই হবে অনু। ওখানে আমার জানাশোনা আছে। নেক্সট উইকেই তোমার অডিশানের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেব।
অনীতা বা তার বাবা অনিমেষ মুখোপাধ্যায় উত্তর দেননি। মুখ দেখে মনে হয়নি এ ব্যাপারে তাঁদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে।
তবে অনীতার ত্রিশ-বত্রিশ বছরের তরুণী মা কিন্তু দারুণ উৎসাহের গলায় বলেছিলেন, নিশ্চয়ই করে দিবি। রেডিয়োতে যাওয়ার কত সম্মান
অনীতার গাট-না সম্পর্কে কী কথা হয়েছিল, আজ আর মনে পড়ে না। খাওয়া-দাওয়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মামি বলেছিলেন, কী সুন্দর গায়। মামা বলেছিলেন বড় ভালো মেয়েটা, কিন্তু বড় দুঃখী।