- বইয়ের নামঃ সিন্ধুপারের পাখি
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. ১৯১১ সালের এক দিন
সিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়
দেজ পাবলিশিং, কলকাতা
SINDHUPARER PAKHI – A Bengali Novel by PRAFULLA Roy Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Deys Publishing
প্রথম দেজ সংস্করণ : এপ্রিল ১৯৮১, বৈশাখ ১৩৮৮
চতুর্থ রাজ সংস্করণ : জানুয়ারি ২০১৩, মাঘ ১৪১৯
পঞ্চম সংস্করণ : জানুয়ারি ২০১৭, মাঘ ১৪২৩
অগ্রজপ্রতিম
শ্রীকানাইলাল সরকার
পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু
.
এই উপন্যাসে কোন জাতি, ধর্ম বা ব্যক্তির উপর কটাক্ষ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমার দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম বা বর্ণের চেয়ে মানুষ অনেক বড়, অনেক মহান। মানুষের মৌল গুণগুলির উপর অটুট বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং আস্থা রেখে এ গ্রন্থ লিখতে চেষ্টা করেছি।
ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পটভূমি এবং আনুষঙ্গিক কিছু কিছু বিষয় ছাড়া এই উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। কোন চরিত্র ও ঘটনার সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে সামান্য মিলও যদি থেকে থাকে তা নিতান্তই যোগাযোগ। এ সম্বন্ধে আমার কোন দায়িত্ব নেই।
যাঁদের অকুণ্ঠ সহায়তা ছাড়া এই উপন্যাস কোনদিনই লেখা সম্ভব হত না, তারা হলেন অগ্রজপ্রতিম শ্রীকানাইলাল সরকার, পোর্টব্লেয়ারের ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধু শ্রীসাধন রাহা, আন্দামান-নিকোবরের এঞ্জিনীয়ার ও হারবার মাস্টার মিঃ স্যাণ্ডেল, শ্রীধীরেন্দ্রনাথ পাল, উত্তর আন্দামানের শ্রীবিকাশ চক্রবর্তী এবং ডাণ্ডাস পয়েন্টের থানাদার শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁদের কাছে আমার ঋণ অফুরন্ত।
এই উপন্যাসের নামকরণ করে দিয়েছেন অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা মনে রেখে নিছক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বাহুল্য মনে করি।
লেখক
কলকাতা
২০শে ফাল্গুন, ১৩৬৫
.
কথামুখ
‘Life is not a series of gig-lamps symmetrically arranged.’
পূর্বদেশীয় উপকথার উল্লেখ আছে, এক অজ্ঞাতনামা সওদাগর দুস্তর সমুদ্রে সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে ‘আন্ধারমাণিক্যে’ পৌঁছেছিলেন। সম্ভবত এই ‘আন্ধারমাণিক্য’ই আন্দামান।
অতীত-কথা মাত্রেই অমৃতসমান। কিছু মোহ, কিছু আবেশ এবং কল্পনার কিছু বিলাস মিশিয়ে চোখ বুজে যে অস্পষ্ট, ধূসর অতীতের ধ্যান করি, তা অতি রমণীয়। তার স্বাদ মধুর।
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের সমষ্টি আন্দামান। তার অতীত কুহেলিবিলীন। ইতিহাসের ফাঁকগুলি কল্পনা আর অনুমান দিয়ে রিফু করে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কয়েক বছর আগেও আন্দামানের সঙ্গে কালা পানি নামে একটা ভয়ানক শব্দ মিশে ছিল। আর এই কালা পানির সঙ্গে মিশে ছিল বিভীষিকা, নিগ্রহ, দ্বীপান্তর এবং কুখ্যাত সেলুলার জেল। কিন্তু এ তো মাত্র বিগত কয়েক দশকের ইতিহাস, আমাদের সকলেরই জানা। সবার জানাশোনার পেছনেও আন্দামানের একটা বিপুল অতীত আছে। এখানে এসেছে বহু দেশ, বহু জাতির মানুষ। নাবিক-বণিক-পরিব্রাজকের মুখে মুখে প্রচলিত হাজার রূপকথায়, কিংবদন্তিতে এবং উচ্চারণভঙ্গিতে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার নাম ছড়িয়ে রয়েছে।
পোর্ট ব্লেয়ারের ফুঙ্গি চাউঙে বসে অনেক কথাই শুনেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন ত্রিকালদর্শী পুরুষ। সে কাল দেখেছেন, এ-কাল দেখছেন এবং যে বোধি থাকলে আগামী কালকে দেখা যায়, তা তার আছে।
বিচিত্র মানুষ লা ডিন। প্রথম জীবনে সুমাত্রা-জাভা-বলিদ্বীপে, শ্যাম-কাম্বোডিয়া মালয়ে-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে বন্দরে নিরুদ্দেশ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আঠার-শ চুরাশি পঁচাশিতে তৃতীয় বার ইংরেজদের সঙ্গে ব্রহ্মদেশের যুদ্ধ বাধে। হঠাৎ ব্রহ্মরাজ থিবোর পক্ষে লড়াই করে বন্দি হয়ে তিনি আন্দামান এসেছিলেন।
প্রথম জীবনের দুঃসাহসী পরিব্রাজক, মধ্য জীবনের সৈনিক, শেষ জীবনে কেমন করে ফুঙ্গি হলেন, সে কাহিনী অন্য। সে-কথা অনেক পরের। তবে সত্তর বছরের জীবনে অনেক দেখেছেন, অনেক শুনেছেন লা ডিন। দেখা এবং শোনার চেয়ে অনেক বেশি বুঝেছেন। বিশাল অভিজ্ঞতা আর বিরাট উপলব্ধির কথা সহৃদয় সমঝদার পেলে তিনি অনর্গল শোনান।
তাঁর কাছেই আন্দামানের অতীত-কথা শুনেছিলাম।
প্রথমেই লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, ঐতিহাসিক টলেমি আন্দামানকে আগাথু ডাইমনস নেসস (উত্তর আত্মার দ্বীপ) বলেছিলেন। আমার মনে হয়, ভুল তিনি করেন নি। খুব খাঁটি কথাই বলেছিলেন। এই দ্বীপে ইনসানিয়াতের বিচার চলছে। হাঁ বাবুজি, নয়া ইনসাফ। এই দ্বীপে একদিন মহান আত্মা জন্ম নেবে।
বর্মী লা ডিনের মুখে হিন্দি এবং উর্দু একাকার হয়ে অদ্ভুত শোনায়। এই বিচিত্র ভাষার মহিমা অনেক পরে বুঝেছিলাম।
.
এবার আন্দামানের ইতিহাস দেখা যাক। কোথায় যেন শুনেছিলাম, পুরাতত্ত্বের তুল্য সরস আখ্যান আর নেই। সময়ের মতো কাহিনীকার মেলা দুষ্কর। গাল্পিক ঘটনা বুনে বুনে গল্প বানান। কিন্তু ইতিহাস হল জাত গল্প। প্রয়োজনের খাতিরে সেখানে ঘটনা ঘটে, চরিত্র সৃষ্টি হয়। সেখানে তাল-মান-মাত্রা বজায় রেখে কল্পনার মিশেল দিয়ে নিটোল কাহিনি ফাঁদবার হাঙ্গামা নেই।
আন্দামানের ঐতিহাসিক কাহিনি অপূর্ব।
অনুমানের ওপর নির্ভর করলে দেখা যায়, খ্রিস্টজন্মের হাজার খানেক বছর আগে চিনা এবং জাপানিরা আন্দামানের কথা জানত। চৈনিক উচ্চারণে আন্দামান ইয়েঙ-ততা-মাঙ হয়েছিল। জাপানিরা বলত আন্দাবান।
বঙ্গোপসাগরের নাবিকরা হাজার হাজার বছর ধরে যে রূপকথা বানিয়েছে তাতে আছে, এক ঝক সাগর-পাখি দিক ভুল করিয়ে দুজন আরব নাবিককে আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। আন্দামানের মাটিতে বিদেশি মানুষের সেই বোধ হয় প্রথম পদক্ষেপ। তারপর কত মানুষই না এল, কত দেশের কত জাহাজই না ভিড়ল!
পূর্বদেশীয় উপকথার সওদাগরই শুধু নন, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় এবং আরব বণিকেরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুণী ও শ্রমণেরা বার বার পূর্ব সমুদ্রে পালের জাহাজ ভাসিয়েছেন। সমাপ্তিহীন বঙ্গোপসাগরের মধ্যপথে আরাম-বিশ্রাম-খাদ্য আর স্বাদু জলের সন্ধানে আন্দামান দ্বীপমালায় তাদের বহর থেমেছে।
সে-সব দিনে মালয়ী ও চিনা জলদস্যুরা আন্দামানের উপকূলে হন্যে হয়ে ঘুরত। সুযোগ পেলেই এখানকার আদিম অধিবাসীদের ধরে নিয়ে শ্যাম, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোচিনের রাজদরবারে বিক্রি করে দিত।
আন্দামানের উপকূলে কত জাহাজডুবি হয়েছে, এই সব দ্বীপের আদিম বাসিন্দাদের তীরে কত নাবিক প্রাণ হারিয়েছে, তার হিসাব কে রাখে। তবু নানা দেশ থেকে এখানে জাহাজ আসার বিরাম ঘটে নি। বিদেশিরা এসে একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে বসেছিল।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, আন্দামানের মিট্টিতে পঞ্চাশটা বছর কেটে গেল। এই দ্বীপের হরেক চীজ দেখলাম। জঙ্গল সাফ হয়ে শহর হল। সেলুলার জেল তৈরি হল। রস্ দ্বীপে রোশনি ফুটে উঠল, আবার নিভেও গেল। কত জাতের কত ধাতের মানুষই দেখলাম! মোপলা দেখলাম, পাঠান-পাঞ্জাবি-কারেন দেখলাম, বর্মী বাঙালি-চিনা দেখলাম।
হ্যাঁ, অনেক দেখেছেন লা ডিন। প্রিয়জন-পরিজনহীন এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দিনের পর দিন কাটিয়ে কত কয়েদি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে কেউ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে হাঙরের দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। ভাগোয়া কয়েদি গভীর অরণ্যে পালিয়ে জারোয়াদের তীরে প্রাণ দিয়েছে। অত্যাচার আর পীড়ন সইতে না পেরে কেউ কেউ ছোট ডিঙিতে বিপুল সমুদ্র পাড়ি দিতে চেয়েছে। তারপর পাহাড়-প্রমাণ ঢেউয়ের মর্জিতে কোথায় ভেসে গিয়েছে, পৃথিবীর কেউ খোঁজ রাখে নি।
অনেক, অনেক দেখেছেন লা ডিন। কয়েদির রক্তে, ঘামে এখানে সড়ক তৈরি হয়েছে। কয়েদির হাড় সাজিয়ে সমুদ্রের দেওয়াল বাঁধা হয়েছে। আন্দামানের মূক মাটিতে অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনেক লোহু, অনেক স্বেদ এবং অভিশাপ গোপন হয়ে আছে।
সবই জানেন লা ডিন।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দেখলাম তো বহুত, পেলাম কী? পেয়েছি বাবুজি, বহুত পেয়েছি, একদিন আপনাকে বলব।
কিন্তু পরের কথা অনেক আগে এসে গেল। এখন উজান ঠেলে না পিছিয়ে উপায় নেই।
.
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের স্থানমাহাত্ম্য যত, নামমাহাত্ম্য তার চেয়ে তিল পরিমাণ কম নয়। কোত্থেকে কিভাবে আন্দামান নামের উদ্ভব, তার হদিস পাওয়া দায়। চিনাদের ইয়েঙ-তো-মাঙ, জাপানিদের আন্দাবান না হয় বাদই দেওয়া গেল।
মার্কো পোলো বঙ্গোপসাগরে ‘আঙ্গামানিয়ান’ নামে দ্বীপমালা দেখেছিলেন। সপ্তম শতকে চৈনিক ভিক্ষু তি সিঙ এই দ্বীপে এসেছিলেন। সে-সময় এর নাম ছিল ‘আগদামান’। ক্লডিয়াস টলেমি এই দ্বীপকে ‘আগমাটে’ নামেও জানতেন। চোদ্দ শ’ চল্লিশে পরিব্রাজক নিকলো কন্টি আন্দামানকে স্বন্দ্বীপ আখ্যা দিয়েছিলেন। যোড়শ শতকে মাস্টার ফ্রেডরিক নিকোবর থেকে পেগু পর্যন্ত এক সারি দ্বীপ দেখেছিলেন। এখানকার বন্য অধিবাসীরা তাদের এই দ্বীপপুঞ্জকে নাকি ‘আণ্ডেমেওন’ বলত। মালয়ীরা আন্দামানের আদিম বাসিন্দাদের বলত ‘হণ্ডুমানী’।
এই নামাবলির কোনটি থেকে ‘আন্দামান’-এর উৎপত্তি, কে বলবে।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, এই আন্দামান সহজ জায়গা নয়। কোতল-রাহাজানি ডাকাতি না করলে এখানে আসা যায় না। যেদিকে তাকাবেন, যে মুখটি দেখবেন, হয় সে হত্যারা, নয় ডাকু। সে জন্যে মনে ঘৃণা রাখবেন না। একটু দরদি হবেন। সকলের বুকে কান রেখে দিলের কথা শুনবেন, তারপর তাদের মুখের দিকে তাকাবেন। দেখবেন, তারা খুব খারাপ নয়। কয়েদিরাও মানুষ।
মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন, বাবুজি, খুনি আর ডাকু ছাড়া অন্য মানুষও আছে। ইণ্ডিয়ার আজাদের জন্য যে-সিপাহিরা.প্রথম লড়াই করেছিল, তাদের নিয়েই আন্দামানের বন্দি কলোনির পত্তন। বর্মাকে আজাদ রাখার জন্যে রাজা থিবোর হয়ে যারা লড়েছিল, তাদেরও এখানে পাবেন। ইণ্ডিয়ার স্বদেশি বাবুদেরও খোঁজ নেবেন। সবারই সাধ ছিল, নিজের নিজের দেশকে আজাদ করবে। কিন্তু–
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন। সামনেই বিরাট বুদ্ধমূর্তি। প্রসন্ন, ক্ষমাসুন্দর, ভগবান তথাগত। তন্ময় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন লা ডিন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। শুনতে পেলাম না।
.
আন্দামানের হাল আমল শুরু হল সতর শ’ আটাশি সালের সেপ্টেম্বর মাসে। লর্ড কর্নওয়ালিস লেফটেনান্ট কোলব্রুক এবং লেফটেনান্ট ব্লেয়ারকে আন্দামান দ্বীপমালায় সার্ভের জন্য পাঠান। তার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে একটি উপনিবেশ পত্তন করা।
ব্লেয়ার এবং কোলব্রুক সার্ভে রিপোর্ট পেশ করলেন। পরের বছরই সেটেলমেন্টের কাজ আরম্ভ হল। কতকালের দুর্ভেগ্য অরণ্য সংহার করে চ্যাথামে এবং বর্তমান পোর্ট ব্লেয়ারে কলোনি তৈরি হল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই সেটেলমেন্টের কাজ উত্তর-পূর্ব দিকের পোর্ট কর্নওয়ালিসে তুলে আনা হয়। বন্দর এবং সুরক্ষিত পোতাশ্রয়ের পক্ষে পোর্ট কর্নওয়ালিস নিরাপদ। কিন্তু এই দ্বীপটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হওয়ায় চার বছরের মধ্যেই সেখানকার কলোনি উঠে যায়।
পুরাতন নথিপত্রে পরবর্তী ষাট বছরের বিশেষ উল্লেখ নেই।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দুনিয়ার হরেক কিসিমের পাপীতাপীর আস্তানা এই আন্দামান। এখানে দেখবেন মদের নেশায় চুর হয়ে কয়েদি নিজের আওরতকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে। এক রতি আফিমের জন্যে মানুষ এখানে চাকু চালায়। এখানে কথায় কথায় কোতল, কথায় কথায় ছোরাছুরি। তবু এই দ্বীপের একটা আত্মা আছে, বড় সন্দুর আত্মা। সেই আত্মাকে খুঁজবেন। তার খোঁজ না পেলে আপনার আন্দামানে আসা বৃথা হবে।
অবাক হয়ে লা ডিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই মানুষটিকে যত দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি।
চোখ বুজে লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন। তার কথাগুলি সাজিয়ে নিলে এমন দাঁড়ায়। সমুদ্রের অতল থেকে এই দ্বীপমালা কবে উঠেছিল, কবে যে নিবিড় অরণ্যের ঘাগরায় নিজেকে সাজিয়েছিল, কে বলবে। সুদূর অতীত, গহীন অরণ্য, চারপাশের গর্জমান সমুদ্র, পাপ-তাপ, আকাশ বাতাস-অন্তরীক্ষ এবং আলো-অন্ধকারের মধ্যে এইদ্বীপের সুন্দর আত্মাটি সঙ্গোপন হয়ে আছে। অতি সন্তর্পণে তাকে খুঁজে নিতে হবে। বার বার হয়তো ব্যর্থ হতে হবে। সে-আত্মা ধরা দিয়েও দেবে না। তবু অসহিষ্ণু হলে চলবে না।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, নিরাকাঙক্ষ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। যোগী-সন্ত ভিক্ষু বাসনা–মুক্ত হয়েই আত্মার মহিমা বুঝতে পারে। আপনি লেখক, মনে মনে আপনিও
তো সাধক—
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন।
.
পোর্ট কর্নওয়ালিসের কলোনি উঠে যাওয়ার পর একটি একটি করে ছোট-বড়-মাঝারি, অনেকগুলি কারণ জমা হচ্ছিল। মালয়ী জলদস্যুদের উপদ্রব, জাহাজডুবি, নাবিকদের ওপর দ্বীপবাসী আদিম মানুষগুলির আক্রমণ, এমনি অসংখ্য। সর্বপ্রধান এবং সর্ববৃহৎ কারণটি পাওয়া গেল আঠার শ’ সাতান্নতে। এই বছরটা সিপাহি বিদ্রোহের বছর। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিদ্রোহীদের বহুদূরে নির্বাসন দেওয়ার একান্ত প্রয়োজন দেখা দিল।
আঠার শ’ আটান্ন সালের চৌঠা মার্চ আন্দামানের ইতিহাস অবিস্মরণীয় তারিখ। এই তারিখেই ডক্টর জে. পি. ওয়াকার দু শ’ জন বন্দি, একজন নেটিভ ওভারসিয়ার, দুজন ডাক্তার এবং ওল্ড ন্যাভাল ব্রিগেডের পঞ্চাশটি রক্ষী নিয়ে সেমিরামিস জাহাজে আন্দামান যাত্রা করলেন।
বঙ্গোপসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালায় স্থায়ী উপনিবেশ পত্তন সম্ভব হল। জীবনের সীমানা দীর্ঘ হল।
লা ডিন বলেছিলেন, ওই যে বললাম বাবুজি, নিরাকাঙ্খ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। কথাটা মনে রাখবেন।
বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে ছিলাম। সেদিকে তাকিয়ে ভাবলাম, নিরাসক্ত এবং নির্লিপ্ত হয়ে আন্দামানের আত্মাকে খুঁজব। এ এক দুরূহ ভাবনা, বড় কঠিন পরীক্ষা। জানি না বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার ঘুরে ঘুরে পাহাড় বনস্পতি-সমুদ্র, মানুষ এবং নিসর্গের মধ্যে তার গহন গোপন আত্মাকে খুঁজে পেয়েছি কিনা।
সে-দিন ফুঙ্গি চাউঙ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন তন্ময় হয়ে তখন বুদ্ধপদ আবৃত্তি করছিলেন। তার কণ্ঠের ঝঙ্কার অনেকক্ষণ ধরে আমার কানে বাজছিল।
ন নগ্গচরিয়া, না জটা, ন পঙ্কা।
অনাসকা থণ্ডিলা সায়িকা বা।
রজোব জল্লং উকুটি কপ্পধানং,
সোধন্তি মচ্চুং অবিতিন্ন কঙ্ক্ষং।
.
আখ্যান
উনিশ শ’ এগার সালের এক দিন।
আউটরাম ঘাট থেকে আড়াই শ’ কয়েদি নিয়ে একটি জাহাজ আন্দামানে পাড়ি দিল। জাহাজটির নাম এস. এস. এলফিনস্টোন।
কাল সমস্ত দিন হুগলি নদীর গৈরিক জল দেখা গিয়েছে। অস্পষ্ট হলেও দু’পারে তীর দেখা যাচ্ছিল। এক ঝক সাগরপাখি মাস্তুলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে আসছিল। দুই তীরের বাঁধনে আকাশটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাকে মাপা না গেলেও তার সম্বন্ধে ধারণা বিরাট ছিল না।
আকাশে শীতের রোদ ছিল, রোদে মাধুর আমেজ ছিল, দিগন্তে ঘন কুয়াশার স্তর ছিল। নদীর ঢেউ কুঁড়ে কুঁড়ে বাতাস উঠছিল, বাতাসে হিম মিশে ছিল। ঠাণ্ডায় মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে তীব্র কনকনানি ছুটে যাচ্ছিল যেন।
কিন্তু শীতের এই রোদ, আকাশ, নদীতীর, কুয়াশা–সবই বড় চেনা। এই কনকনানির অনুভূতি বড় পরিচিত।
তারপর একটি রাতের কারসাজিতে এমন বিস্ময় ঘটে গেল। এক ফুঙ্কারে পরিচিত পৃথিবীটা কোথায় অদৃশ্য হল। কোথায় পড়ে রইল রূপনারায়ণের মোহানা আর কোথায় রয়ে গেল সাগদ্বীপ!
ডায়মণ্ড হারবার পেরিয়ে গেরুয়া জল যখন সবুজ হল, তখনও শীতের বেলাশেষ নিভু নিভু আলো দিচ্ছিল। একটু পরেই ছায়া ছায়া অন্ধকার নেমেছিল। তারপর স্যান্ড হেডের মুখে এসে বৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে নদী কখন সঙ্গমে মিশল, কখন সবুজ জল নীল হল, নীল কখন কালাপানি হয়ে নিঃসীম সমুদ্র হয়ে গেল–সে কথা আড়াই শ’ কয়েদি একবারও ভাবে নি। এমন বিপুল বিস্ময় তারিফ করার মতো মনই নয় তাদের।
আজ আর পারাপার নেই, দিকচিহ্ন নেই। ভরসা দেওয়ার মতো আকাশের কোথাও একটা সিন্ধু-শকুনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কালকের চেনাজানা তীর, গৈরিক জলের নদী, কালকের আকাশ বাতাস আজ নেই, কোথাও নেই।
বিশাল সমুদ্র এখানে গর্জায়, গহীন সমুদ্র এখানে অবিরাম ফেঁসে। পাহাড়প্রমাণ তরঙ্গ মালা ফুলে ফুলে যেদিকে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে মিশেছে, বিচিত্র আক্রোশে সেদিকে ধাওয়া করে।
ওপরে অবাধ আকাশ, নিচে অবারিত নোনা সমুদ্র। আকাশ আর সমুদ্র এখানে পাল্লা দিয়ে দিগ্বিদিকে ছোটে।
এর নাম বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গোপসাগর–গভীর, গম্ভীর, ভয়ঙ্কর, কখনও বা প্রমত্ত। মুহূর্তে মুহূর্তে এর রূপ বদলায়, মেজাজ বদলায়। এর হঠকারিতার অন্ত নেই, এর খামখেয়ালকে বিশ্বাস নেই। কখন যে কালা পানি মেতে উঠবে, ঝড় তুলবে, কখন যে ফুলে ফুলে জল আকাশ-সমান উঁচু হবে, আর কখন যে একান্ত অবলীলায় মহাকায় জাহাজ ডুবিয়ে অথৈ অতলে টেনে নেবে, আগে থেকে হদিস মেলে না।
.
বিরাট একটা জলচর মাছের মতো ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে এস. এস. এলফিনস্টোন। জাহাজ এখন দক্ষিণগামী।
অনেক আগেই সকাল হয়েছে।
অগাধ সমুদ্র থেকে একটি সোনালি গোলক একটু একটু করে আকাশের গা বেয়ে জাহাজের মাথায় এসে উঠেছে। দরিয়ার সূর্য, তার তেজ ভয়ানক।
নীল আকাশটা ঝকঝক করে। টুকরো টুকরো হালকা মেঘ উত্তর থেকে দক্ষিণে, আড়াআড়ি পাড়ি জমায়। নিচে নোনা জলের দরিয়া ফুঁসতে থাকে। সমস্ত সমুদ্র জুড়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, শুধু কোটি কোটি ঢেউয়ের মাথা ঝকমক করে।
চার নম্বর হ্যাচে তিন কয়েদি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ছিল। মাঝখানের কয়েদিটির মাথা দু’হাঁটুর মধ্যে গোঁজা। কোমর থেকে শরীরের ওপরের অংশটা নগ্ন। পরনে লম্বা লম্বা কালো দাগকাটা ইজের। গায়ের রং পোড়া তামার মতো। চওড়া কাঁধ, মজবুত গর্দান। বিরাট দেহে থরে থরে কঠিন পেশি। মাথার চুল নিরপেক্ষ ভাবে ছোট এবং সমান করে ছাঁটা। দু’পায়ে লোহার বেড়ি। নাম লখাই।
ডান পাশ থেকে একটা গলা শোনা গেল, লখাই ভাই—
লখাই মাথা তুলল। ঘোর ঘোর রক্তাভ চোখ, মণি দু’টি লাল। উদ্ধত চোয়াল, চোখের নিচে হনু দু’টি অতি প্রকট। রোমশ বুক, চ্যাপ্টা নাক, মাংসল কাঁধ। সমস্ত শরীরে মোটা
মোটা শক্ত হাড়।
ডাইনে তাকাল লখাই। দেখল, তোরাব আলি সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
সারা মুখে হিংস্র ভঙ্গি ফুটল লখাইর। ভাঙা, কর্কশ গলায় সে বলল, আঁই হারামী, কী কইচিস?
কালা পানি রে লখাই ভাই! ফিসফিস স্বরে তোরাব আলি বলল। তার গলায় কাঁপুনি ধরেছে।
হুঁ। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে আবার হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজল লখাই।
আকারে প্রকারে তোরাব আলি লখাইর মতো মারাত্মক নয়। বেঁটেখাটো দোহারা চেহারা। কিন্তু ছোট ছোট গোলাকার চোখ দুটো অতি ধূর্ত, অতি কুটিল। ঠোঁটের পাশ থেকে কান পর্যন্ত ডান গালে পুরু কাটা দাগ। এই দাগটা এবং কুটিল একজোড়া চোখ তার মুখটাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
তোরাব আলি ফের ডাকল, লখাই ভাই—
লখাই জবাব দিল না।
আপন মনেই এবার তোরাব বলতে লাগল, সমুন্দরের পার কূল নাই। দরিয়া দেখে বুকের লৌ যে পানি হয়ে যায়। হা আল্লা, কোথায় জন্ম দিলে আর কোথায় মারতে নিয়ে চলেছ। তোমার মর্জি বুঝি না।
অনেকটা সময় কাটে।
লখাই কথা বলে না। এই বিপুল সমুদ্রের মতোই আল্লার মর্জির পারকুল না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে তোরাব।
জাহাজটা মুহূর্তের জন্য থামে না। ধক ধক অদ্ভুত শব্দ করে অবিরাম ছুটতে থাকে। চাকার ঘা লেগে লবণসমুদ্র গেঁজে ওঠে। কালো দরিয়ায় পুঞ্জ পুঞ্জ তুষারের মতো সাদা
ফেনা ফোটে।
চারদিকে শুধু জল, কালো কুটিল জল। নিঃসীম, অফুরন্ত বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর তো কোনোদিন শুকোয় না, কোনোকালে ফুরোয় না। এর জলতলের মাটি কেউ কখনও দেখে নি, চিরকাল গোপন হয়েই আছে।
তোরাব হঠাৎ বলে, জবর ডর লাগে লখাই ভাই–
ডর লাগে! দু’হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে তাকায় লখাই। বলে, কেন?
দরিয়া দেখে, কালা পানি দেখে।
লখাই খেপে ওঠে। রক্তাভ চোখজোড়া জ্বলতে থাকে। সে বলে, মানুষের খুন দেখে ডর লাগে না, পানি দেখে লাগে! চুপ মার কুত্তা, এটুন ঘুমুতে দে।
জাহাজের দোলানিতে কাল সারারাত এক দণ্ড ঘুমাতে পারে নি লখাই। কপালের দু’পাশে সরু সরু রগগুলো যন্ত্রণায় ফুলে উঠেছে, দাপাদাপি করছে। মোটা মোটা আঙুলে টিপেও তাদের বাগ মানানো যাচ্ছে না।
বিরক্ত চোখে ভোরাবের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাঁটুর ফাঁকে মাথা নামায় লখাই।
আর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পাশ থেকে আর্তনাদ ওঠে।
চমকে তাকায় লখাই। লোকটা দুহাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদছে। আউটরাম ঘাটেই প্রথম দেখেছে, লোকটা বর্মা মুলুকের। নামটাও জেনে নিয়েছে লখাই। মঙ চো।
ধারাল কনুইটা দিয়ে মঙ চোর পাঁজরে সজোরে খোঁচা দিল লখাই। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, কি রে শালা, চিল্লাচ্ছিস কেন?
মুখ থেকে হাত নামায় মঙ চো। কুতকুতে চাপা চোখ দুটো কান্নায় বুজে গিয়েছে। মুখটা বিকৃত দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় হাউ হাউ করে কী যে সে বলে, কিছুই বোঝা যায় না। হাত বাড়িয়ে বার বার সে সামনের সমুদ্র দেখায়।
লখাই চেঁচায়, হারামীটা কী বলে রে, এট্টুও বুঝি না।
তোরাব বলে, দরিয়া দেখে বুঝি ডর লেগেছে বর্মীটার।
ডরপোক। বিদ্রুপে পুরু পুরু কালো ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল লখাইর। নিরোম দ্রুর তলায় হিংস্র চোখজোড়া কোঁচকাল। লখাই গর্জে উঠল, কুত্তা কঁহাকা, ভাগ এখান থেকে। আমার পাশে বসে মাগীদের মত ফাঁচফাঁচ করতে পারবি না।
বলতে বলতে মঙ চোর কাঁধ ধরে প্রবল ঝকানি দিল লখাই। আবার বলল, কাদলে অ্যায়সা কুনুই হাঁকাব—
মঙ চো কী বুঝল, সে-ই জানে। একবার লখাইর দিকে তাকাল। কাল জাহাজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিদারুণ কান্না জুড়েছে। এখনও থামে নি। পুরা একদিন সে কিছু খায় নি, শোয় নি, সমানে কাঁদছে। চোখ দুটো ফুলে উঠেছে।
মঙ চোর ফোলা ফোলা কুতকুতে চোখে কাতর দৃষ্টি ফুটল। তার পরই দুহাতে মুখ ঢাকল সে। আর শব্দ করল না। শুধু শরীরটা থরথর কাঁপতে লাগল।
মঙ চোর দিকে থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে অনেক উঁচুতে তুলল লখাই। আশ্চর্য! একটা সাদা সাগরপাখি মাস্তুলের ডগায় বসে রয়েছে।
লখাই রুক্ষ স্বরে গজগজ করে, খালি ডর আর ডর। অতই যদি ডরাস, তবে কালা পানি যেতে চেয়েছিলি কেন রে হারামীর বাচ্চারা! আই–
একটু থামে লখাই। আবার শুরু হয়, সমুদুর দেখেই মড়াকান্না লাগিয়েছিস! শালা আন্দামানে নেমে যে দম ফেটে খতম হয়ে যাবি। বিশ সাল ঘানি ঘোরাবি কেমন করে!
সময় কাটতে থাকে, রোদের তেজ বাড়ে। মাস্তুলের ডগায় সাগরপাখিটা যেন ঝলসে যাচ্ছে।
এবার মঙ চোর কাঁধে হাত রাখে লখাই। নরম গলায় বলে, কাঁদবিই যদি, তবে খুন করেছিলি কেন? জানিস না, খুন করলে হয় কঁসি, নয় কালা পানি। ওই সব কঁদুনি ভুলে যা মঙ চো। আন্দামান হল জাহান্নাম জায়গা। সেখানে কার কাছে কাঁদবি মানিক? ঘরের মাগ আছে সেখানে?
আরো অনেকটা সময় কাটে। কেউ আর কিছু বলে না। রোদের রং হলদে হয়ে আসে।
একসময় তোরাব বলে ওঠে, তার গলাটা বড় করুণ শোনায়, লখাই ভাই, তা হলে আমরাদ্বীপান্তরেই চললাম!
ভারী গলায় লখাই বলে, হাঁ রে, হাঁ। যাচ্ছিস আর মালুম পাচ্ছিস না?
শালার দিলটা জবর খারাপ হয়ে গেছে। লখাইর দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করে তোরাব। চোখ দুটো সামান্য চিকচিক করে।
লখাই বলে, কী হল আবার?
বিবির কথা মনে পড়ছে। ভাঙাভাঙা, অদ্ভুত গলায় তোরাব বলতে থাকে, বিবির পেটে ছানা রয়েছে। আসার সময় জাহাজঘাটে খুব একচোট কাদল সে, বলল। ছেলে জন্মে কুনোদিন তার বাপজানের মুখ দেখতে পাবে না। একটু ছেদ, তারপর বলে, ঠিকই বলেছে বিবি, আন্দামান থেকে আর কুনোদিন ফিরতে হবে না। আর ছেলেও শালা বাপজনের মুখ দেখবে না।
লখাই জবাব দেয় না। খুনখারাপি, রাহাজানি–দুনিয়ার সব রকম ভীষণতার সঙ্গে তার পরিচয় আছে। লালসা, মত্ততা–এগুলির মহিমা সে পুরোপুরি বোঝে। কিন্তু বিষাদে মন যখন নরম হয়, তার মুখে উপযুক্ত জবাব যোগায় না।
তোরাব আবার বলে, দিলটা গোরস্থান হয়ে গেছে। কিছুই ভাল লাগে না। খেয়ে শুয়ে বসে জুত পাই না। খালি বিবির পেটের ছানাটার কথা ভাবি।
লখাইর গলাটা বিষণ্ণ শোনায়, আন্দামান যাচ্ছিস তোরাব। ঘর-সংসার বিবি-বাচ্চার কথা ভুলে যা। যত ভাববি, দিল তত বিগড়োবে।
ভুলতেই তো চাই। কিন্তুক খোদা কি ভুলতে দেবে? কোতল করেছি–হিসেব করে গুনাহর সাজা দেবে না? একটু থামে তোরাব। বড় বড় শ্বাস টানে। অল্প অল্প হাঁপায়। তারপর বলে, দরিয়ার এ-পারে থাকবে বিবি, অনেক ফারাকে দরিয়ার ও-পারে থাকব। আমি। খোদার ইচ্ছা, দিনরাত বিবির কথা ভাবিয়ে ভাবিয়ে আমাকে খতম করবে।
এবার লখাই উত্তর দেয় না। স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। তার চোখের পাতা পড়ে না।
তোরাব বলে, কী করি বল দিকি লখাই ভাই? বিবির কথা ছেলের কথা ভেবে কুননা কালে তত দিলটা এমন বিগড়ে যেত না!
বড় করুণ দেখায় তোরাবকে। তার কদাকার মুখখানা এই মুহূর্তে তত খারাপ মনে হয় না।
দিলকে ফুর্তি দেওয়ার মতো একটি মাত্র অমোঘ প্রক্রিয়ার কথাই জানা আছে লখাইর। ভড়ে ঊড়ে নির্জলা তাড়ি গিলে, ভাড়া-করা কোনো মেয়েমানুষের ঘরে উন্মত্ত রাত্রি কাটানো। তাড়ির উগ্র ঝাঁঝাল স্বাদে এবং তীব্র উত্তেজক নারীমাংসে যে মৌতাত জমে, তাতে ঝুঁদ হয়ে থাকলে বিগড়ানো দিল আপনিই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আন্দামানগামী এই জাহাজে ওই বস্তু দু’টি নেহাতই নাগালের বাইরে। তা ছাড়া, হাঠাৎই লখাইর মনে হয়, দুনিয়ার সব মন-খারাপের প্রতিকার বোধ হয় নেশায় এবং নারীমাংসে নেই।
বলি বলি করেও দিলকে ফুর্তি দেবার মতো অমোঘ উপায়টার কথা তোরাবকে বলতে পারে না। অদ্ভুত বিষাদে মনটা ভরে যায়। উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে লখাই।
তোরাব ডাকে, লখাই ভাই–
আচমকা লখাই খেঁকিয়ে ওঠে, চুপ মার। সেই থেকে ঘ্যানঘ্যান লাগিয়েছে! শালা যেন একাই বিবি ছেড়ে এসেছে–
বঙ্গোপসাগরের ঢেউ ফুঁড়ে খুঁড়ে জাহাজ ছোটে। বিপুল সমুদ্র পেরিয়ে কবে যে আন্দামানের কূল মিলবে, কে জানে।
তিনটে কয়েদি চার নম্বর হ্যাচের ওপর নির্বাক, নিস্পন্দ বসে থাকে।